শুক্রবার, ২৯শে জুন, ২০১৮ ইং ১৫ই আষাঢ়, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

মাচেরানো, রক্তের বিন্দু দিয়ে লড়াই করা যোদ্ধা

স্পোর্টস ডেস্ক: গাল কেটে গেছে? রক্ত ঝরছে? ঝরুক না! কী বললে, চোখের পাশটাও কেটে গেছে? রক্ত? ধুর! এভার বানেগা তাঁর পুরোনো সহযোদ্ধার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন। ম্যাচে, যাও, অন্তত মুখটা মুছে আসো! মাচেরানো হেসে উড়িয়েই দিলেন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, বানেগাকে কী উত্তর দিলেন। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী রক্তাক্ত খেলোয়াড়কে মাঠে খেলতে দেওয়া হয় না। তুর্কি রেফারি মাচেরানোর কাছে এসে কথাটা বলার সাহসই হয়তো পাননি। মাচেরানো যেভাবে পাথরমুখ করে লড়ে যাচ্ছিলেন, আজ শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও লড়ে যেতেন। থামানো যেত না তাঁকে!

অনেকে বলেন, এই দলের নেতা আসলে মাচেরানোই। লিওনেল মেসি মুখচোরা। সেই স্বভাব তো আর বদলানো যাবে না। সৃষ্টিকর্তা তাঁকে বানিয়েছেনই শুধু পায়ে ফুটবল দিয়ে কথার ফুল ফোটানোর জন্য। তবু মাচেরানোর কাছ থেকে অধিনায়কের বাহুবন্ধনী মেসিকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর মাচেরানো নিজে এগিয়ে এসে তখনকার বার্সেলোনা সতীর্থের কাঁধে তুলে দিয়েছেন এই বাহুবন্ধনী। আর্জেন্টিনার বাহুবন্ধনী তো ১০ নম্বরেরই প্রাপ্য।

তবু কি এই দলের নেতা তিনি নন! যতই অস্বীকার করা হোক, কোচের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ ঘটে গেছে এই দলে। মাচেরানো কী করেছেন। গত কয়েকটা দিন দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করে গেছেন। কখনো কোচের সঙ্গে বসছেন। কখনো কথা বলছেন দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে। আজকের ম্যাচের নেপথ্য কোচ নাকি তিনিই। না হলে সাম্পাওলিকে ৪-৪-২ ছকের মতো সরল সমীকরণে একাদশ সাজাতে রাজি করানো প্রায় অসম্ভব ছিল।

আগের মতো গতি আর নেই। বয়স! বার্সেলোনাকে দীর্ঘদিন নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়ে এখন ঠিকানা করে নিয়েছেন চীনের ফুটবলে। এই সেদিন আর্জেন্টিনার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড করলেন। মাচেরানো এই বয়সেও আর্জেন্টিনা দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন কেবল মনের জোরে। নিজেও বোঝেন, পারেন না আগের মতো। না হলে গত বিশ্বকাপের নেপথ্য কারিগর তো তিনিই। সেমিফাইনালে গোলমুখে সাবমেরিনের মতো ধাবমান আরিয়েন রোবেনকে শেষ মিনিটে ও রকম স্লাইডিং ট্যাকেলটাই যার সাক্ষী হয়ে আছে। আর্জেন্টিনা অনেকের হিসাব পাল্টে দিয়ে ফাইনালে উঠেছিল হাতেগোনা যে কজন খেলোয়াড়ের কারণে, ম্যাচে তাঁর একজন।

কিন্তু গতবার ভাগ্য এবং গঞ্জালো হিগুয়েইন মুখ তুলে তাকাল না। গতবার বিশ্বকাপ জিতলে এখন তাঁর বাড়িতে বসে মেয়েদের সঙ্গে টিভিতে বিশ্বকাপ দেখার কথা। জানেন, এই দলটাকে শরীরের শক্তি দিয়ে দেওয়ার জোর কমে গেলেও মনের জোর আগের মতোই আছে।

এবার তাঁর কারণে আর্জেন্টিনা ভুগেছে, এও সত্যি। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে দুটি গোলে ভূমিকা আছে মাচেরানোর গতি হারিয়ে ফেলা। আজও দলকে ডোবাতে বসেছিলেন। তাঁর কারণেই পেনাল্টি পেয়েছে নাইজেরিয়া। যদিও ফাউলটা মেনে নিতে পারছিলেন না কিছুতেই। পারছিলেন না, ওই এক পেনাল্টি গোলের কারণে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার রূঢ় বাস্তবতা দুয়ারে যে উঁকি দিয়েছে, তাও মানতে।

এ কারণে এমন ক্ষত নিয়েও খেলে যাচ্ছিলেন। পেনাল্টির ওই ভুলটুকু আর প্রথমার্ধে তাঁর পা থেকে বার তিনের বল কেড়ে নেওয়া বাদে কী করেননি আজ। খেলেননি কোথায়! ৩৫-এ পা দিয়েও কী জানটাই না লড়িয়ে দিলেন! খেলার মাঝবিরতিতে টানেলে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে, আর ঝাঁজালো ভাষণ দিচ্ছেন মেসি…এই অবিশ্বাস্য দৃশ্যের জন্মদাতাও হয়তো তিনি। যখন মেসির সঙ্গে বেরিয়ে আসছিলেন, কী যেন বললেন ডেকে। হয়তো মনে করিয়ে দিলেন, ‘লিও, যে গোলটা করেছিস, এরপর দলকে কিছু বল। তুই-ই পারবি!’

এই মাচেরানোকেই গতবার দেখা গেছে সেমিফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটে দলকে কীভাবে উজ্জীবিত করছেন! অধিনায়ক মেসি জটলার বাইরে একা দাঁড়িয়ে, আর মাচেরানো বাকিদের বোঝাচ্ছেন। বোঝাচ্ছেন, আকাশি-সাদা জার্সিটা মানে কত আবেগ। এখানে হিসাব চলে না। এখানে দলের শক্তিমত্তার নিক্তিতে মাপ চলে না।

আজ হেরে গেলে কথা উঠত। স্মৃতি বড় প্রতারক। সমর্থকদের স্মৃতি তো আরও দুর্বল। সবাই আজ দুষত তাঁকে। কিন্তু নামটা যে মাচেরানো। একজন লড়াকুর। যাঁকে নিয়ে কাব্যগাথা হয় না। মহাতারকা হয়ে ওঠার সৌভাগ্য তাঁর নেই। তবু তিনি শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দু উৎসর্গ করে দিতে রাজি। এই দলের আসল নেতা যদি কেউ হয়ে থাকে, সে একজনই!

Print Friendly, PDF & Email