ধর্ষণের সময় চিৎকার করায় শর্মিলাকে গলা টিপে হত্যা করে তজিবর
যশোরের চৌগাছায় মাদ্রাসাছাত্রী শর্মিলাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যার কথা স্বীকার করেছে এ ঘটনায় গ্রেফতার তজিবর।
বৃহস্পতিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে আসামি তজিবর। নিজের সম্পৃক্তার দায় স্বীকার করেছে সে।
তবে পরিবারের সদস্যদের সন্দেহভাজন আরও পাঁচজনকে এজাহারভুক্ত না করায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের দাবি, ছয়জনকে আসামি করা হলেও পুলিশ একজনকেই এজাহারভুক্ত করেছে।
আর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, পরিবারের দেয়া এজাহারই রেকর্ড করা হয়েছে। বাদী একজনকেই আসামি করেছেন। সেই আসামিই দায় স্বীকার করেছে।
তজিবর মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার বিলধরা গ্রামের তবির উদ্দিনের ছেলে ও চৌগাছার ফকিরাবাদ গ্রামের আবদুল বারিকের জামাই।
জানা গেছে, গত ২২ জুন বিকালে যশোরের চৌগাছা উপজেলার ফকিরাবাদ গ্রামের হাবিবুর রহমানের মেয়ে মাদ্রাসাছাত্রী শর্মিলা খাতুন (১০) বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে চৌগাছা থানায় একটি জিডি করা হয়। ঘটনার চার দিন পর স্থানীয় একটি আম বাগানের পাশ থেকে শার্মিলার পচাগলা লাশ উদ্ধার করে স্থানীয়রা।
শর্মিলার প্যান্ট দেখে লাশ শনাক্ত করে পরিবার। এরপর হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছয়জনকে স্থানীয়রা ধরে পুলিশে দেয়।
নিহতের পরিবারের দাবি, গ্রামবাসী প্রধান আসামি তজিবরকে ধরে ফেলে। এরপর তজিরব জানায়- চৌগাছার ফকিরাবাদ গ্রামের আবু বক্করের ছেলে জাহাঙ্গীর, তার ছেলে রাজু, জাহাঙ্গীরের জামাই ও জলিল ওরফে ভাষণের ছেলে সুমন, জাহাঙ্গীরের বোনের স্বামী ও রফিকুলের ছেলে তুষার, এবং তুষারের ছেলে নাহিদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত। এরপর গ্রামবাসী তাদেরকেও ধরে পুলিশে সোপর্দ করে।
এরপর নিহতের বাবা চৌগাছায় থানায় মামলা করেন। মামলায় ছয়জনের নাম থাকলেও একজনের নাম এজারভুক্ত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নিহত শিশুর বাবা হাফিজুর রহমান ওরফে কালু সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ রাতে আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে থানায় নিয়ে একটি কাগজে স্বাক্ষর করে নেয়, বলে মামলা করা হচ্ছে। মামলায় একজনকে আসামি করা হয়েছে তা আমাকে জানানো হয়নি। আমি অভিযুক্ত সবাইকেই আসামি করেছি বলে জানি।
এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চৌগাছা থানার এসআই আকিকুল ইসলাম বলেন, বাদী এজাহার পড়ে, শুনে ও দেখে একজনকে আসামি করেছেন। বাদীর দেয়া এজাহারই রেকর্ড করা হয়েছে। আটক আসামি তজিবরকে বৃহস্পতিবার আদালতে সোপর্দ করা হয়। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে নিজের সম্পৃক্ততার দায় স্বীকার করেছে। আর কারো সম্পৃক্ততার কথা বলেনি তজিবর। প্রাথমিক তদন্তেও তজিবর ছাড়া আর কারো সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলেনি।
বৃহস্পতিবার যশোরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. বুলবুল ইসলাম আসামি তজিবরের জবানবন্দি গ্রহণ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।
জবানবন্দিতে তজিবর বলে, চৌগাছার তৈমুর রহমানের আম বাগানে পাহারাদারের কাজ করত। শর্মিলা প্রতিদিন এই বাগানে আম কুড়াতে যেত। গত ২২ জুন দুপুরে শর্মিলা বাগান থেকে আম কুড়িয়ে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার আগে শর্মিলা আবারও বাগানের আম কুড়াতে যায়। এ সময় তার সঙ্গে গিয়ে কয়েকটি আম কুড়িয়ে দিই।
আরও : ২৫ বছরে যেসব টুর্নামেন্টে ব্যর্থ হয়েছে আর্জেন্টিনা
সে বলে, এর মধ্যে শর্মিলাকে নিয়ে পাশের মেহগনি বাগানে নিয়ে গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে ধর্ষণ করি। এ সময় শর্মিলা বিষয়টি তার বাড়ির লোকজনকে বলে দেবে ও চিৎকার করছিল। তার চিৎকার বন্ধ করতে গলা চেপে ধরি। এর মধ্যে শর্মিলার শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়। শর্মিলার লাশ মেহগনির পাতার স্তূপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে পালিয়ে যায়।
এদিকে তজিবর জবানবন্দিতে লাশ মেহগনি পাতার স্তূপে রেখে পালিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও এলাকাবাসী ও নিহতের স্বজনরা দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
তাদের ভাষ্য, নিহত শিশু শর্মিলার বড় বোন হাকিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী উর্মিলা খাতুনকে (১৩) জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে ফটকা মুন্সির ছেলে রাজু প্রেমের প্রস্তাব দেয়। এ ঘটনা জানাজানি হলে উভয় পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধে। একপর্যায় রাজু তাদের দেখে নেয়ার হুমকি দেয়।
এই ঘটনার প্রায় এক মাস পর গত ২২ জুন সন্ধ্যায় উর্মিলার ছোট বোন শর্মিলাকে আম দেয়ার নাম করে রাজু ও তুষারের ছেলে নাহিদ আম বাগানে ডাকে।
শর্মিলার পরিবারের দাবি, রাজু ও নাহিদ তাকে ধর্ষণ করে। সে চিৎকার দেয়ার চেষ্টা করলে তার শ্বাসরোধ করা হয়। একপর্যায়ে শর্মিলার মৃত্যু হলে ঘটনাটি রাজু তার বাবা জাহাঙ্গীরকে বলে। এ সময় জাহাঙ্গীর তার ছেলে রাজু ও রাজুর বন্ধু নাহিদকে বকাঝকা করে। লাশ কি করবে কোথায় রাখবে, মৃত্যু ঘটনাটি কীভাবে চাপা দেয়া যাবে এ নিয়ে তারা বেশ চিন্তায় পড়ে যায়।
স্থানীয়রা আরও জানায়, ঘটনার প্রায় তিন ঘণ্টা পর রাত ৯টার দিকে জাহাঙ্গীর আম বাগান থেকে লাশ নিয়ে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়িতে শর্মিলার লাশ নিয়ে এসে ঘরের বারান্দায় রাখা হয়। এরপর লাশের পেট চিরে নাড়িভুঁড়িসহ মাথা ও হাত পায়ের মাংস কেটে ফেলে জাহাঙ্গীর।
পরবর্তীতে লাশ পলিথিন বন্দি করে ঘরের বারান্দায় রাখা বড় সাব-বাক্সে রাখে। তাদের ধারণা লাশের মাংস ও নাড়িভুঁড়ি বের করলে গন্ধ ছড়াবে না। কিছু দিন পর শুকিয়ে যাওয়া কংকাল কোথাও ফেলে রেখে আসবে। কিন্তু ঘটনার চার দিন পর পচা দুর্গন্ধ বের হতে শুরু করলে সন্ধ্যার পরে লাশ বাক্স থেকে বের করে পাশেই আম বাগানে ফেলে তা লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়।
যে ঘরের বারান্দায় শিশুটিকে কাটা ছেড়া করা হয় ওই ঘরের বান্দায় এখন রক্তের ছাপ ছাপ দাগ লেগে আছে। বাড়িটি থেকে পচা দুর্গন্ধ ও ব্যাপক কেরসিন তেলের গন্ধ বের হচ্ছে। তাদের ধারণা জাহাঙ্গীর একাই শিশুটিকে এভাবে কাটাছেঁড়া করে বাক্সবন্দি করেছে।
তবে এই অভিযোগ মানতে নারাজ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চৌগাছা থানার এসআই আকিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আপনাদের মতো আমিও অনেক কিছু শুনছি। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তে তার সত্যতা পাইনি। আটক তজিবর নিজেই হত্যার দায় স্বীকার করেছে। তার স্বীকারোক্তিতে পরবর্তীতে হত্যায় ব্যবহৃত গামছা উদ্ধার করেছি।
তিনি বলেন, জনগণ যখন তজিবরকে আটক করেছিল, বাঁচার জন্য হয়তো সে জাহাঙ্গীরসহ বাকিদের নাম বলতে পারে। কিন্তু আদালতে জবানবন্দিতে শুধু নিজের সম্পৃক্ততার কথা বলেছে তজিবর।
যদিও বাদী দাবি করেছে, জাহাঙ্গীরের ঘরে রক্তের দাগ রয়েছে। আমরা আলামত সংগ্রহ করেছি। তবে বাক্সে লাশ রাখার কোনো আলামত পায়নি। একই সঙ্গে একটি প্লাস্টিকের পুরনো বস্তা আলামত হিসেবে নিয়েছি।
এক প্রশ্নের জবাবে এসআই আকিকুল বলেন, ধারণা করছি কুকুর, শেয়াল কিংবা অন্য কোনো প্রাণিতে শিশুর নাড়িভুঁড়ি খেয়েছে। বাচ্চার নরম মাংস, খেয়ে ফেলতে পারে।
তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, বাদীর বড় মেয়েকে নিয়ে জাহাঙ্গীরের ছেলের সঙ্গে একটা সমস্যা হয়েছিল। সেই ঘটনার জের ধরে বাদী জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজনকে সন্দেহ করছে। বাদীকে বলেছি ওসি স্যারের সঙ্গে কথা বলতে। তার অভিযোগের বিষয়টিও আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখবো। নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি।