শুক্রবার, ২৯শে জুন, ২০১৮ ইং ১৫ই আষাঢ়, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

রাজধানীতে বেপরোয়া মোটরসাইকেল

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীতে চলাচলকারী বেপরোয়া মোটরসাইকেল নগরবাসীর নতুন আতঙ্কের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত কয়েক বছরে নগরীতে ব্যাপকসংখ্যক মোটরসাইকেল ও আরোহী বেড়ে যাওয়ায় সড়ক ও ফুটপাথের যাত্রী ও পথচারীরা বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়েছেন। যানজটের নগরীতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সড়ক ছেড়ে ফুটপাথে উঠে আসছে মোটরসাইকেল। তরুণ আরোহীদের অনেকেই রাস্তায় প্রতিযোগিতায় নামছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সহজ শর্তের বিক্রয় নীতিমালার কারণে বর্তমানে মোটরসাইকেলের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে অসংখ্য মানুষের।

সড়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবেই রাজধানীতে দিনে ২৭১টি নতুন মোটরসাইকেল রাস্তায় নামছে। আর রেজিস্ট্রেশনবিহীন কত মোটরসাইকেল রাস্তায় চলছে সে হিসাব কারও কাছেই নেই। যানজটের সংকীর্ণ রাস্তায় এক দেড় ফুট জায়গা পেলেই ফাঁক গলে ছুটে চলে মোটরসাইকেল। নগরীতে গণপরিবহনের স্বল্পতা ও ভোগান্তির কারণে দ্রুত গন্তব্যে যেতে মোটরসাইকেলের নির্ভরতা বাড়ছে। বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে রাজধানীতে নিবন্ধিত হয়েছে ৩২ হাজার ৫৬২টি মোটরসাইকেল। সে হিসাবে প্রতি মাসে ৮ হাজার ১৪০ আর প্রতিদিন ২৭১টি করে নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধন নিয়েছে। রাজধানীতে নিবন্ধন পাওয়া যানবাহনের অর্ধেকের বেশি মোটরসাইকেল। এই চার মাসে রাজধানীতে সব ধরনের ৫৬ হাজার ২৫১টি যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ে রাজধানীর সড়কে দিনে ৪৬৮টি নতুন যানবাহন যোগ হয়েছে।

সম্প্রতি অ্যাপভিত্তিক রাইড সেবায় মোটরসাইকেল যুক্ত হওয়ায় বাহনটির চাহিদা-জনপ্রিয়তা ও সংখ্যা আরও বাড়ছে। সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে সড়কে বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি। মোটরসাইকেলগুলো ট্রাফিক আইনের কোনো তোয়াক্কা করছে না। সিগন্যাল উপেক্ষা করছে অধিকাংশ সময়। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অবাধে ফুটপাথেও চলাচল করছে। যানজটবহুল রাস্তায় অপেক্ষা না করে দল বেঁধে ফুটপাথ দিয়ে চলাচল করছে মোটরসাইকেল। ফলে পথচারীরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। এমনকি পথচারীদের কেউ বিরক্তি প্রকাশ করলে তাকে হেনস্তা করতেও দেখা গেছে।

প্রতিবাদ করলে মোটরসাইকেল আরোহীরা পথচারীদের গালাগাল করে চলে যান। ফুটপাথে মোটরসাইকেল চলাচল করায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। সময় বাঁচাতে নিয়ম ভেঙে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন চালকরা। সিগন্যালে বেশি সময় আটকে থাকলে অধৈর্য বাইকাররা ট্রাফিক পুলিশকেও উপেক্ষা করে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তীব্র হর্ন দিয়ে বেপরোয়া গতিতে ফুটপাথের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চলার দৃশ্যও যেন রাজধানীতে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পথচারীরা বলছেন, ফুটপাথ হচ্ছে পথচারীদের হাঁটার জন্য। কিন্তু আমাদের ফুটপাথ পথচারীদের জন্য নয়। ফুটপাথে অনেক রকম বিশৃঙ্খলার সঙ্গে মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিনই পথচারীদের সঙ্গে মোটরসাইকেল চালকদের ঝগড়া হাতাহাতিতে রূপ নিচ্ছে।

উল্লেখ্য, ফুটপাথে মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়, কোনো অবস্থায়ই হাঁটার পথে মোটরবাইক চালানো যাবে না। এ আদেশের পরে পুলিশ প্রশাসন কিছু দিন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালায়। পরে ধীরে ধীরে আগের অভ্যাসে ফিরে যায় বাইকাররা। রাস্তায় জ্যাম হলেই ফুটপাথে উঠে যায় মোটরসাইকেল। সর্বশেষ ফুটপাথে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ ফুটপাথের মাঝখানে লোহার পাইপ দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। তারপরও মোটরসাইকেল চালকদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না।

এদিকে বৈধ রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরসাইকেলের চলাচল, বাইকে চড়ে ছিনতাই ও খুনসহ নানা অপরাধ বাড়ছে নগরীতে। নগরীতে ছিনতাই ঘটনাসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত অবৈধ মোটরসাইকেল। উঠতি বয়সী কিশোর তরুণরা বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোয় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এ কারণে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা এবং অপরাধ দমনে মোটরসাইকেল নিয়মিত তদারকি করা দরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত ‘উদ্বেগজনক’। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু ঝুঁকির বিবেচনায় মোটরসাইকেল অত্যন্ত বিপজ্জনক বাহন। কারণ দেশের মোট সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ ঘটে মোটরসাইকেলের কারণে। বিশেষ করে তরুণ আরোহীরা মোটরসাইকেল চালালে তাতে গতির কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এ জন্য সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলের সম্পৃক্ততা ও তরুণ আরোহীদের মৃত্যু তুলনামূলকভাবে বেশি।

ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, মোটরসাইকেল সড়ক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। এ জন্য এসব যানবাহনের চালকদের বাধ্যতামূলকভাবে হেলমেট পরা, গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ ট্রাফিক আইন মেনে চলাচলে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, মানুষ দ্রুত তার গন্তব্যে যেতে চায়। এ জন্য রাজধানীর গতিহীন সড়কে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে। যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হলে মোটরসাইকেল নিয়ে এত দুর্ভাবনার কারণ হতো না। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Print Friendly, PDF & Email