গাজীপুরের নগরপিতা জাহাঙ্গীর
নিজস্ব প্রতিবেদক: গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দ্বিগুণের বেশি ব্যবধানে জয় পেয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
মোট ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪১৬ কেন্দ্রের ফলাফল বেসরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৪ লাখ ১০ ভোট। অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬১১ ভোট।
বড় ধরনের সহিংসতা ছাড়াই দেশের সবচেয়ে বড় এ সিটি করপোরেশনে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। কাউন্সিলরদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হওয়া ছাড়া আনন্দমুখর পরিবেশে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সহিংসতা ও জালভোটের ঘটনায় ৯টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।
ভোটগ্রহণ শেষে এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিবউদ্দীন মণ্ডল জানিয়েছেন, ভোট খুব সুন্দর, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ৫৫-৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে। বিএনপি যে কয়টি অভিযোগ করেছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। ৪২৫টি কেন্দ্রের নয়টিতে গোলযোগ হয়েছিল, সেগুলোর ভোট বন্ধ করে দিয়েছি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন গাজীপুর সিটির মতো সুষ্ঠু হবে বলে আশা করছেন তিনি। তবে হাসানউদ্দিন সরকার অভিযোগ করেন,ধানের শীষের এজেন্টকে শতাধিক কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ৭ মেয়রপ্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ৫৭ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ২৫৬ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৮৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
সকালে কিছু সময় বৃষ্টি হওয়ায় কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল কম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ভোটার উপস্থিতি। সকাল সোয়া ৮টার দিকে আউচপাড়ায় বশির উদ্দিন উদয়ন একাডেমি কেন্দ্রে ভোট দেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকার। এ সময় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট হবে না এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, নির্বাচনে আমি আছি, থাকব। এই নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। জনগণ যদি ফল মেনে নেয়, তাহলে আমিও মেনে নেব। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সাদা গাড়িতে আমাদের নেতা-কর্মীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রায় ১০ কেন্দ্র থেকে আমার এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে। সকাল ৭টা থেকেই বিএনপিদলীয় এজেন্টদের কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া শুরু হয়। তবে কোন কেন্দ্র তা বলতে পারেননি। দুপুর ১টার দিকে গাজীপুর জেলা বিএনপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বন্ধের দাবি জানান হাসান সরকার। পরে ভোট বন্ধের দাবি সংবলিত লিখিত অভিযোগ নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। সেখানে হাসান সরকার সাংবাদিকদের বলেন, শতাধিক কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে সিল মারা ও জালভোট দেওয়া হয়েছে। এসব অনিয়মের কারণে আমি এ নির্বাচন বন্ধের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
সকাল সোয়া ৯টার দিকে নিজ এলাকা কানাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দেন জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় তিনি বলেন, জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। তারপরও জনগণ যে রায় দেবে তা মেনে নেব। সত্যকে গ্রহণ করার শক্তি আমার আছে। ভোটগ্রহণের শেষ পর্যায়ে হাসান সরকারের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়মী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে ফল প্রশ্নবিদ্ধ করতে তিনি এসব অভিযোগ তুলছেন।
এদিকে ভোটগ্রহণ চলাকালে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। সাক্ষাৎ শেষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার যেভাবে চেয়েছে, সেভাবে সাজানো নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনকে ‘ধন্যবাদ’।
অন্যদিকে ভোটগ্রহণের মধ্যেই নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল। এ সময় তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এসব করছে বলে অভিযোগ করছে। নৌকায় ব্যালট মারার যেসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, তা বিএনপির ষড়যন্ত্রেই হচ্ছে। এসব বিষয়ে ইসি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে পুরুষের তুলনায় নারী ভোটারের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া কয়েকটি কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট পাওয়া যায়নি।
সিটির পূর্ব সীমান্তে ২৮ ওয়ার্ডের লাঘারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ৮টি বুথে নৌকা ও ধানের শীষের এজেন্ট পাওয়া গেছে। তবে কেন্দ্রের বাইরে স্থাপিত ধানের শীষের বুথে ডিবি পুলিশ হামলা করেছে বলে অভিযোগ করেন হাসান সরকারের কর্মীরা। মো. সোহেল আমিন নামের এক কর্মী বলেন, ১১টার দিকে সাধারণ পোশাকের কয়েক ডিবি পুলিশ সদস্য এসে হঠাৎই আমাদের ওপর হামলা চালান। এতে আমাদের দুই কর্মী আহত হয়েছেন।
এ ছাড়া ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের মির্জা ইব্রাহিম হাইস্কুল কেন্দ্রে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দুপুর দেড়টা থেকে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। এই কেন্দ্রের কোনো বুথে ধানের শীষের এজেন্ট পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার শ্যামল চন্দ্র হালদার বলেন, কিছু যুবক ভোট কারচুপি করতে এলে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তা চেয়েছি। বিএনপির এজেন্ট প্রসঙ্গে বলেন, তারা শুরুতে ছিলেন, পরে কখন যে চল গেল দেখিনি।
সিটির ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের আশরাফ টেক্সটাইল মিল হাইস্কুল কেন্দ্রেও দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষের কারণে দুপুরের পর কিছুক্ষণ ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। এই ওয়ার্ডের বিএনপি সভাপতি জসিম দেওয়ান বলেন, আমাদের ১২টার পরে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এ ওয়ার্ডের আরও কয়েকটি কেন্দ্র থেকে ধানের শীষের এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে আশরাফ টেক্সটাইল কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার জিএম কামরুজ্জামান বলেন, ১ নম্বর বুথে কয়েক যুবক সিল মারার চেষ্টা করে। আমি গেলে তারা আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে সটকে পড়ে। এসব ব্যালট বাতিল করা হবে বলে জানান তিনি।
বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় জয়দেবপুরে শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে কিছু লোক জালভোট ও কেন্দ্র দখল করতে গেছে এমন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এনে ২৬ নং ওয়ার্ডের বিএনপি দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী হান্নান মিয়া হান্নু ও আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল করিমের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটলে উপস্থিত ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রের বাইরে কাউন্সিলর প্রার্থীদের লোকজন শোডাউন ও মিছিল করেন। খবর পেয়ে বিজিবি, র্যাব ও অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনার সময় শিববাড়ী-শিমুলতলী সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এ ছাড়া ভোগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জালভোট দেওয়ার সময় ওই কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়। অনিয়ম ও গোলযোগের অভিযোগে খরতৈল মনসুর আলী আদর্শ বিদ্যালয়, দেওড়া হাজি পিয়ার আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দত্তপাড়া এলাকার জাহান পাবলিক স্কুল ও কোনাবাড়ীর এমইএইচ আরিফ কলেজ, পুবাইলের বিন্দান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুনিয়া এলাকার হাজি আবদুল লতিফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম জয়দেবপুরের মদিনাতুল উলুম সিনিয়র মাদ্রাসা কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করেন নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার।
নয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত
সহিংসতা ও ভোট জালিয়ারিতর অভিযোগে নয় কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। কেন্দ্রগুলো হলোÑ ৯ নম্বর ওয়ার্ডের এমইএইচ আরিফ কলেজ, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভোগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র-১, ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের বিন্দান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের জাহান পাবলিক দত্তপাড়া কেন্দ্র, ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের খরতৈল মনসুর আলী আদর্শ বিদ্যালয়ের দুটি কেন্দ্র এবং ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের টঙ্গীর দক্ষিণ আউচপাড়ার হাজি কাসিম উদ্দিন বিএম অ্যান্ড কমার্স কলেজ কেন্দ্র।