ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরে যে হামলা ও মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে তাতে ইন্ধন দেয় পাশের মাধবপুর উপজেলার লোকজন। ওই উপজেলার একজন মুয়াজ্জিন মাইকে ঈমানি দায়িত্ব পালনে এলাকাবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। সে কথা শুনে সেখান থেকে ১৪টি ট্রাকে করে হাফ প্যান্ট পরা লোকজন হামলায় অংশ নেয়।’
রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা সদরের আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক।
এ সময় তিনি আরও দাবি করেন, ‘‘আমি ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলে কাউকে কটূক্তি করেননি।’’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা সারা থানা ঘুরে যান। যদি নাসিরনগরের একজন হিন্দু লোকও বলতে পারে আমি আমার জীবনে ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলেছি তাহলে এখনই মন্ত্রীত্ব থেকে ত্যাগ করবো। হিন্দুদের হেফাজতে যথাযথ ভূমিকা না রেখে নিজেদের মধ্যে একটি মিথ্যা খবরের ভিত্তিতে কাদা ছোঁড়াছুড়ি করা মানেই ক্ষতিগ্রস্তদের আরও হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং পূজা উদযাপন পরিষদের মতো সংগঠন এই ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে আমাকে অভিযুক্ত করায় আমি অত্যন্ত মর্মাহত। তাছাড়া রানা দাস গুপ্ত নিজেই সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি শোনা কথার ভিত্তিতেই এই অভিযোগ তুলেছেন।’’
তিনি আরও বলেন, ‘রসরাজ দাস ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার ওই ছবি আপলোড করেননি। গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছবিটি ঢাকা থেকে পোস্ট করা হয়েছে। কারা এই ছবিটি কারা পোস্ট করেছে তার তদন্তও চলছে। এই ছবিটি এখন ফরেনসিক ল্যাবে আছে। নাসিরনগরের দুই চারটা লোক এই ষড়যন্ত্র করছেন, আর কেউ না।’
সাংবাদিকরা ষড়যন্ত্রকারীদের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা ষড়যন্ত্র করছে আমি সবসময় তাদের মোকাবিলা করে আসছি।’
১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম উপজেলা প্রশাসনের যে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন তার ব্যাখ্যা দিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘নাসিম সাহেবকে ভুল বুঝানো হয়েছে। নাসিম সাহেব নয়, আমি ফিল্ডে আছি।’
সমাবেশের অনুমতি দেওয়া প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রশাসনের কোনও ব্যর্থতা নেই। প্রথম দিকের পরিস্থিতিটা তারা সামাল দিয়েছেন। ওসি নিজে আহত হয়েছেন। আর দলের যেসব নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে তারা ভালো মানুষ। ওই দিন পরিস্থিতি শান্ত করতে গিয়ে তারাও আহত হন। একজনের চোখও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে জেলা আওয়ামী লীগের এ সিদ্ধান্তের আমি নিন্দা জানাই। আমার সঙ্গে কথা না বলে তারা এমনটি করতে পারে না।’
মন্ত্রী দাবি করেন, ‘তার সুনাম ক্ষুণ্ন করতেই এ ঘটনা ঘটানো হয়ছে। একটি মহল অপচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। আমি মনে করি, সেই ব্যর্থতার গ্লানি ঢাকতেই আমার নির্বাচনি এলাকায় শুধু কথিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে তারা আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, আমার জীবন থাকতেও আমি হিন্দু ভাইবোনদের ক্ষতি করার মাধ্যমে আমার সুনামহানির ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে দেব না। যারা পরিকল্পিতভাবে ট্রাকে করে মন্দির ভাঙচুর করতে এবং বাড়িঘরে আগুন দিতে এসেছিল তাদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে একটি মাত্র থানা রয়েছে যেটা সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ, সেটা হলো নাসিরনগর থানা। এই থানা নৌকার প্রতীক বহন করে।’
সাংবাদিকদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘নাসিরনগরে নামকা ওয়াস্তে একটি প্রেসক্লাব আছে। যা ঘটনার আগে সবসময় বন্ধ থাকতো। কিন্তু এ ঘটনার পর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। কিছু সাংবাদিক সেখানে অবস্থান নেয়।’
এ সময় মন্ত্রী প্রশ্ন করেন কারা সাংবাদিকদের থাকার জায়গা দেয়? কারা তাদের খাবার দেন? পরে উপস্থিত সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করলে তিনি বলেন,‘যারা এমনটি করেছে আমি শুধু সেসব সাংবাদিকদের কথা বলছি, সবার কথা নয়।’
প্রসঙ্গত, গত ২৮ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের এক যুবকের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ছবি পোস্ট করা হয় যা মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার পর স্থানীয়রা ওই যুবককে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। খবর ছড়িয়ে পড়লে ৩০ অক্টোবর সকাল থেকে নাসিরনগর উপজেলা সদরের কলেজ মোড় এবং খেলার মাঠে একাধিক ইসলামি দলের নেতারা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। সমাবেশ চলাকালে হঠাৎ তিন থেকে ৪শ’ লোক সংঘবদ্ধ হয়ে এ ঘটনার জন্য হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর চড়াও হয়। এসময় পুরো উপজেলা সদরের হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবার এবং তাদের মন্দিরের ওপর হামলা চালায় তারা।
অভিযোগ রয়েছে, হামলাকারীদের থামাতে পুলিশ, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। পরে রাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে কাজল দত্ত এবং নির্মল চৌধুরী বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। এসব মামলায় অজ্ঞাত ১২শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে।