বিশেষ প্রতিনিধি , ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দির ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় দুটি মামলা। সম্প্রীতি সমাবেশ
ফেসবুকের একটি ছবিকে কেন্দ্র করে গত শনিবার থেকেই উত্তেজনা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। কিন্তু এলাকার মন্দিরগুলোর নিরাপত্তায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নামের দুটি সংগঠনকে ধর্মীয় সমাবেশ করার অনুমতি দেয় উপজেলা প্রশাসন।
স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেন, ওই সমাবেশ এলাকায় উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে। সমাবেশ থেকেই বিভিন্ন মন্দিরে হামলা চালানো হয়। তবে দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
রোববার হিন্দুদের বাড়ি ও মন্দিরে হামলার পর গতকাল দুটি মামলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সবাই গতকাল সারা দিন নাসিরনগরে ছিলেন। তাঁরা শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য সমাবেশও করেন। এই সমাবেশেও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
নাসিরনগর উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি আদেশ চন্দ্র দেব বলেন, ফেসবুকের একটা ছবি নিয়ে শনিবার থেকেই এলাকায় উত্তেজনা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে দুটি সংগঠনকে ধর্মীয় সমাবেশ করার অনুমতি দেয় প্রশাসন। প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই ১৫টি মন্দিরে ভাঙচুর, লুটপাট হয়েছে। হামলা হয়েছে হিন্দু নারী-পুরুষদের ওপর।
নাসিরনগরের সবচেয়ে বড় সর্বজনীন মন্দির মহাকাল পাড়ার গৌর মন্দির। রোববার সমাবেশ চলাকালে এই মন্দিরের সামনে কয়েকজন পুলিশ সদস্য থাকলেও পশ্চিম পাড়ার জগন্নাথ মন্দির, নমশূদ্র পাড়ার কালীবাড়ি মন্দির, মহাকাল পাড়ার শিবমন্দির, দুর্গামন্দির, শীলপাড়ার লোকনাথ মন্দির, দত্তপাড়ার দত্তবাড়ি মন্দির, সূত্রধর পাড়ার কালীমন্দিরসহ আরও সাতটি পারিবারিক মন্দিরে পুলিশ ছিল না। আর গৌর মন্দিরে পুলিশ
থাকলেও তারা হামলাকারীদের ঠেকাতে পারেনি। বরং এখান থেকে পুলিশ পাশের কাশীপাড়ায় চলে গেলে পরে এই গৌর মন্দিরেও হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। মন্দির ছাড়াও সদরের দত্তপাড়া, ঘোষপাড়া, গাংকুলপাড়া পাড়া, মহাকাল পাড়া, কাশিপাড়া, নমশূদ্রপাড়া, মালিপাড়া, শীলপাড়াতে হিন্দুদের ৬০-৭০টি বাড়িঘরেও ভাঙচুর, লুটপাট হয়েছে।
গৌর মন্দিরের পুরোহিত শংকর গোপাল দাস হামলাকারীদের হামলায় আহত হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এ ঘটনাকে ভয়াবহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেলা ১১টার দিকে প্রথমে কয়েক শ লোক মন্দিরে হামলা করতে আসে। পুলিশ তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করে। পরে আরও লোকজন দা, লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে হামলা চালায়। তারা মন্দিরের রুপা, কাঁসা, পিতল ও তামার বিভিন্ন মূর্তি নিয়ে যায়। তিনি দরজা আটকে পূজা করছিলেন। দরজা ভেঙে তাঁকে পেটানো হয়।
গৌর মন্দির থেকে আধা কিলোমিটার দূরেই পশ্চিম পাড়ার জগন্নাথ মন্দির। এই মন্দিরের পূজারী নারায়ণ চক্রবর্তী বলেন, বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে লোকজন নৌকায় করে মিছিল করে সদরে আসে। কেউ তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করেনি। আর মন্দিরেও নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। শত শত লোক এসে এখানে হামলা চালায়।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের রসুরাজ দাস (৩০) নামের এক যুবকের ফেসবুক থেকে ইসলাম ধর্মের অবমাননার একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল ওই যুবকের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। আশপাশের ঘরগুলোও তালাবদ্ধ ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, ছেলেটি পেশায় জেলে, একেবারেই অশিক্ষিত। যে ছবিটি ফেসবুকে দেওয়া হয়েছে, সেটি ফটোশপ করা। সাধারণ কারও পক্ষে এমন ছবি তৈরি করা সম্ভব নয়।
ওই গ্রামের বাসিন্দা স্বপন দাস, সজল দাস ও রতন দাস বলেন, হামলাকারীরা বয়সে তরুণ। কাউকেই তাঁরা চেনেন না। শনিবার রাত থেকেই তারা জড়ো হচ্ছিল। কিন্তু কেউ তাদের ঠেকায়নি। গ্রামের গৌর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বৃদ্ধা লক্ষ্মী রানী দাস কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘একজন দোষ করলে তার বিচার হবে। এভাবে সবাইকে কেন কাঁদাল? বাড়িঘর ভাঙচুর করল, আমাদের কী দোষ?’
অভিযুক্ত রসুরাজ দাস শনিবার দুপুরে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন কারাগারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল করিম জানিয়েছেন, ছেলেটি বারবার বলছে, তার ফেসবুকে অন্য কেউ এটা পোস্ট করেছে। অবশ্য গতকাল তার ফেসবুকে ছবিটি আর পাওয়া যায়নি। ফেসবুকে সর্বশেষ তিনি লিখেছেন, ‘কীভাবে আমার আইডি থেকে ছবিটি পোস্ট করা হলো, আমি জানি না। দেখার সাথে সাথেই ছবিটি ডিলিট করেছি। আমি সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’
উত্তেজনার মধ্যেও কেন সমাবেশের অনুমতি দিলেন জানতে চাইলে নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমেদ বলেন, ‘শনিবার ছেলেটিকে গ্রেপ্তারের পরও বিকেলে মিছিল হয়েছে। এরপর আহলে সুন্নাতের দুই অংশ আমাদের কাছে রোববার সমাবেশের অনুমতি চায়। তারা বলে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবে। ভেবেছিলাম, সমাবেশ করলে আর সমস্যা হবে না। তাই অনুমতি দিয়েছিলাম।’ সমাবেশের অনুমতি দিলেও মন্দিরগুলোর নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন করলেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা পুলিশ বলতে পারবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাসিরনগর সদর থানায় বর্তমানে ৩২ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। দুটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য ১২ জন পুলিশকে আখাউড়ায় পাঠানো হয়। বাকি পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন গৌর মন্দিরে থাকলেও বেশির ভাগই ছিলেন সমাবেশে।
নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদের এ বিষয়ে বলেন, ‘মূলত সমাবেশের দিকেই পুলিশের নজর ছিল। ফলে মন্দিরগুলোতে নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। পরে যখন হামলা শুরু হয়, তখন পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়েছে। কিন্তু হামলাকারীরা সংখ্যায় এত বেশি ছিল যে কিছুই করার ছিল না।
তবে নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ টি এম মনিরুজ্জামান সরকার বলেন, ‘শনিবার থেকেই এলাকায় উত্তেজনা। রোববার সকাল নয়টায় আমি নিজে ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি। পুলিশ চাইলে আমরা জনপ্রতিনিধিরা মিলে এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন সেটা করেনি।’
মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় নাসিরনগর থানায় গতকাল দুটি মামলা হয়েছে। প্রতিটি মামলায় ১০০০ থেকে ১২০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। উপজেলা সদরের দত্তবাড়ি দুর্গামন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় কাজল জ্যোতি দত্ত ও সদরের মহাকালপাড়া গৌর মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় নির্মল চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা দুটি করেন।
মন্দির ও বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় গতকাল বেলা সাড়ে তিনটায় উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে একটি শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশে জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, একটি ঘটনা নাসিরনগরের এত দিনের সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে না। এলাকায় সবাই ভাই ভাই। এক ভাই অন্য ভাইয়ের ক্ষতি করতে পারে না। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ শুরু করেছে।
পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান সমাবেশে বলেন, ঘটনার তদন্ত চলছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান সরকার, ইউএনও চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন দেব, উপজেলা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আহ্বায়ক রিয়াজুল করিম, খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম শহীদুল হক প্রমুখ।
এ হামলার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষাসচিব আবদুর রহিম বলেন, ‘ফেসবুকে কেউ কাবা শরিফকে অবমাননা করে যে অন্যায় করেছে, সে তো গ্রেপ্তার হয়েছিল। আইনের মাধ্যমেই তার বিচার হবে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কে বা কারা এই হামলা করেছে, প্রশাসন ভালো জানে।