আমিরজাদা চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের গ্রামগুলো ভীত সন্ত্রস্ত জনপথে পরিণত হয়েছে। গত রবিবারের তান্ডবের পর গতকাল সোমবার উপজেলা সদরে উদ্বেগ আতংক বিরাজ করছিল। সাধারণ মানুষের আনাগোনাও কমে গেছে বাজার গুলোতে। জেঠাগ্রাম, নুরপুর, নরহা, হরিনবেড়, দত্তপাড়া, ফার্মগেট বাজার এলাকার দোকানপাট সোমবার দুপুরের দিকেও বন্ধ দেখা গেছে। সরজমিন পরিদর্শন কালে স্থানীয়রা জানায়, রবিবার হামলার পর আতংক থেকেই দোকানপাট তেমন খুলছে না ব্যবসায়ীরা। আতংকে উদ্বিগ্ন পরিবারের কর্তারা নারী-পুরুষকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছে। তবে পুলিশ বলছে, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। ক্রমশই স্বাভাবিক হয়ে আসছে নাসিরনগরের জনজীবন।
রবিবার মন্দির ভাংচুরের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। অন্য দিকে পুরো ঘটনা তদন্তে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন পৃথক ২টি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সোমবার বিকেলে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নাসিরনগরে শান্তি সম্প্রীতি সমাবেশ হয়। এতে মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাংচুরকারীদের বিচার দাবী করা হয়। পাশাপাশি সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার জন্য উদাত্ত আহবান জানান। গৌর মন্দিরের ভাংচুরের ঘটনায় সাধারন সম্পাদক নির্মল চৌধুরী বাদি হয়ে ১০০০/১২০০ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করে। দত্তবাড়ির দূর্গা প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনায়ও কাজল জ্যোতি দত্ত মামলা দায়ের করেন। এ মামলায়ও আসামী করা হয় ১০০০/১২০০জনকে। পুলিশ জানিয়েছে, এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ৮জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত রবিবার রাতে ৬ জন এবং সোমবার সকালে ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে হামলায় অংশগ্রহনকারীদের নাম ঠিকানা জেনে তাদেরকেও মামলায় আসামী করা হবে। তবে দু’টি মামলাতে অজ্ঞাত লোকদের আসামী করা হয়েছে। দত্তবাড়ির কমলা দত্ত জানান, আমরা আতংকে মধ্যে রয়েছি। হামলার সময় শিশুরা ভয়ে চিৎকার করছিল। কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, আমরা তো অপরাধ করেনি। যে অপরাধ করেছে তার বিচার হোক। আমরা এর বিচার চাই। গীতা দাস জানান, হামলার পর থেকে আতংক অবস্থায় আছি। কখন যে কি হয়?
এদিকে সংখ্যালঘুদের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অপসারন দাবি করেছে জেলা আওয়ামীলীগ। অন্যদিকে নাসিরনগরের পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও সংখ্যালঘুদের মধ্যে চরম আতংক বিরাজ করছে। সোমবারও পুলিশের পাশাপাশি বিজিবির সদস্যদেরও রাস্তায় টহল দিতে দেখা গেছে। নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাদের জানান, দু’টি মামলাতেই বাদী পক্ষ অজ্ঞাতদের আসামী করেছে। তবে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে নাম-ধাম সংগ্রহ করে হামলাকারীদের সনাক্ত করে আসামী করা হবে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরো জানান, হামলাকারীদের গ্রেফতারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে।
এদিকে সোমবার বিকেলে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শান্তি সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক মোঃ রেজওয়ানুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান পিপিএম, নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ.টি.এম মনিরুজ্জামান সরকার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন কুমার দেব, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হামিদা লতিফ পান্না। শান্তি সমাবেশে ইউনিয়নের বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। এদিকে নাসিরনগরে নৃশংস ঘটনায় এখন পর্যন্ত জেলার সুশীল সমাজ মুখ খোলেনি। কোন সংগঠনের পক্ষ থেকে অসহায় সংখ্যালঘুরে পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এ নিয়ে সচেতন মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে পবিত্র কাবা শরীফকে অবমাননা করে আপত্তির ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করার ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের পরও একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করে গত রবিবার নাসিরনগরে হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিভিন্ন মন্দির ও বাড়ি-ঘরে ভাংচুরের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের কঠোর হস্তে দমন করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি সামাজিক শান্তি ও ধর্মীয় চেতনা রক্ষা এবং নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টিকারীদের অপতৎপরতা প্রতিহত করতে প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ এবং নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল কাদেরের দ্রুত অপসারন দাবি করে জেলা আওয়ামীলীগ। রবিবার রাতে স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মহিউদ্দিন খান খোকন স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই দাবি করা হয়।
পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ডটকমকে জানান, নাসিরনগরে সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রনে আছে। আমরা সেখানে শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ করে জনগনকে শান্ত থাকার আহবান জানিয়েছি। নাসিরনগরের ঘটনায় জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ৩ (তিন) সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ইকবাল হোসাইনকে প্রধান করা হয়। কমিটিকে ৩ কার্য দিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান জানান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। ১০ (দশ) কর্ম দিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩(সদর) আসনের সংদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেছেন, আমি এ ঘটনায় মর্মাহত। যারা অপরাধী তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা এবং উস্কানীই এর জন্য দায়ী।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার নাসিরনগর উপজেলা হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাস-(৩০) পবিত্র কাবা শরীফ অবমাননা করে মহাদেবের মুর্তি কাবা শরীফের উপর বাসিয়ে ফেইজ বুকে পেষ্ট করে। আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোষ্ট করে। এ ঘটনায় শনিবার স্থানীয় লোকজন রসরাজ দাসকে ধরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। এ ঘটনায় শনিবার রাতেই রসরাজের বিরুদ্ধে নাসিরনগর থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করা হয়। রবিবার এ নিয়ে বিক্ষোভ হয়। উত্তেজিত জনতা উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ করে বেশ কিছু হিন্দু বাড়ি-ঘর এবং দত্তবাড়ি মন্দির, জগন্নাথ বাড়ি মন্দিরসহ ১২টি মন্দিরে হামলা ও ভাংচুর করে। হামলাকারীরা লুটতরাজও করে। খবর পেয়ে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব সদস্যরা বিকেল ৩টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।