মানুষকে ভালবাসার দীক্ষাগুরু হিরন্ময় তারকা প্রয়াত অধ্যাপক একেএম হারুনুর রশীদ
---
আল আমীন শাহীন : “অনেক রক্তে গড়া এই স্বদেশ,অনেক রয়েছে ঋণ” লিখে শিখিয়েছেন প্রিয় শিক্ষক প্রয়াত একেএম হারুনুর রশীদ। স্বদেশের জন্য নানা কীর্তি ত্যাগ ভালবাসার এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। দেশ মাটি ও মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ,যাঁর অবদানের ঋণ ও শোধ হবার নয়। “ওযু করে মাগো দু রাকাত আজ নফল নামাজ পড়ো, দুঃখিনী এই বাংলাকে মা প্রাণ ভরে দোয়া করো” গানটি প্রায়শই কানে বাজে। মা এবং দেশের প্রতি হারুণ স্যারের যে প্রগাঢ় ভালবাসা তা গানের এক লাইনেই ফুটে উঠে। নিজে ভালবেসেছেন এবং ভালবাসার আলো বিলিয়েছেন আমারই মতো শত হাজার ভক্ত ছাত্র অনুসারীদের। হিরন্ময় শব্দটি স্যার প্রায়শই ব্যবহার করতেন। হারুণ স্যার ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাসীর কাছে চির আলোকিত এক হিরন্ময় তারকা।ব্র্রাহ্মণবাড়িয়ার কাউতুলীতে শহীদ বুদ্ধিজীবিদের যে সৌধটি আছে এর“সৌধ হিরন্ময়” নামকরণ করেছিলেন স্যার। পাশে থেকে স্যারের এমন নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাসে হিরন্ময় যুগল হচ্ছে হারুন স্যার এবং দিলারা আপা।
হারুণ স্যার ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বেতার কেন্দ্র তিনি পরিচালনা করেছিলেন,তিনি একজন ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক, সংস্কৃতিসেবীদের অনন্য অভিভাবক, শিশু সংগঠক অসাধারণ প্রতিভার একজন কবি লেখক নাট্যকার শিল্পী। অন্যদিকে উনার স্ত্রী বেগম দিলারা হারুণ ছিলেন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, মাননীয় সংসদ সদস্য, সংস্কৃতিসেবী, যন্ত্রসংগীত শিল্পী,নারী অধিকার আদায়ে রাজপথের লড়াকু নেত্রী,কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের নেত্রী, সমবায় আন্দোলনের পথিকৃত একজন মমতাময়ী শিশু সংগঠক। এ যুগলের ভালবাসার আচ্ছাদনে কেটেছে আমার শৈশব কৈশোর আর যৌবন। এইযুগলের মৌলভীপাড়ার কবিতাঙ্গন আমার সংস্কৃতি চর্চার শিক্ষাঙ্গন। প্রাইমারীতে মিশন স্কুলে পড়ি যখন সেখানেই প্রথম দেখি হারুণ স্যারকে। নাটকের নির্দেশনা স্যারের কাছ থেকে পাই তখন থেকেই। তারপর মাধ্যমিক , উচ্চ মাধ্যমিক কেটেছে স্যারের পেছন পেছনে আন্তরিক সান্নিধ্যে। চলায় বলায় গলায় যা কিছু সবই স্যারের অবদান। ৮০ দশকের শুরুতে একটি নাটকে শিশু চরিত্রে আমি আর প্রয়াত কবি মতিউল ইসলামের কন্যা চুমকি অভিনয় করবো। স্যার নির্দেশনা দিচ্ছিলেন সড়ক বাজারের শিল্প সাহিত্য চক্রে। আমাকে খুঁজে খুজে এক সময় আব্বা আমাকে এসে পেলেন নাটকের মহড়ায়। আব্বা কিছুটা রেগে ছিলেন, নাটক নাটক করে আমার জীবন শেষ হবে এমন করলেন স্যারের কাছে। স্যার ব্যতিক্রমী হাসিতে আব্বাকে বল্লেন, সংস্কৃতি চর্চা কাউকে অমানুষ করে না, সুন্দর আর আলোকিত করে। আব্বা বলেছিলেন, আপনার হাতেই ছেলেটিকে ছেড়ে দিলাম।”সেই থেকে স্যারই আমার পিতৃতুল্য অভিভাবক হলেন, একই সঙ্গে দীর্ঘ জীবন পথে কর্মজীবন পর্যন্ত। শুধু আমি নই আমার মতো অনেক সন্তান আছে স্যারের, যাঁরা স্যারের আলোর দীক্ষায় আলোকিত নানাভাবেই। ২০০৫ সালের ৮ নভেম্বর স্যার চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
আমি তখন দৈনিক দিন দর্পণের সম্পাদকের দায়িত্বে, স্যারকে নিয়ে দেওড়ার অগ্রদূতের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, স্যারের সংবর্ধনার নিউজটা লিখছিলাম ঠিক সেই মুহুর্তেই খবর এলো স্যার নেই, কি লিখবো তখন , স্যারের সংবর্র্ধনা না মৃত্যুর সংবাদ। থমকে গেছিলাম সেদিন , কাগজ ভিজেছিল চোখের জলে। এখনও থমকে যাই স্যার নেই, মনে হলেই জলের ধারা চোখ ভেজায়। স্যারের সব কিছুই আছে , শুধু স্যারের কণ্ঠে কবিতা গান সংলাপ ¯েœহমাখা শব্দ শুনি না , পাই না পদযুগলের ছোঁয়া। স্যারের শূন্যতা আমার মাঝেই নয় অনেকের মাঝেই। কেটে গেছে এক যুগ , ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গন সরব থাকতো স্যারের কর্মচাঞ্চলতায় তা চলছে স্যারের শূন্যতায়। এটাই বাস্তবতা। তবে বর্তমান সময়ে স্যারের বড্ড প্রয়োজন ছিল। দুঃসময়ের দুঃশাসনে যখন নানা প্রতিবন্ধকতা প্রতিকুলতা তা ডিঙ্গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে অগ্রনায়ক ছিলেন হারুণ স্যার। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারের সময় অনেক কিছুই তিনি করতে পারতেন। অপূর্ণ নানা স্বপ্ন পূরণ হতো স্যারের এই সময়েই। দুঃসময়ে জয়বাংলা শব্দ যখন উচ্চারণে ছিল বাঁধা স্যারের শিক্ষা দীক্ষায় নানাভাবেই জয়বাংলা উচ্চারণ করেছি আমরা নাটকে সংলাপে। স্যারের নির্দেশে ৮৮ সালে “আবার শ্লোগান আবার যুদ্ধ” নাটকে জয়বাংলা ধ্বনীতে প্রকম্পিত করেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী কলেজের ক্যাম্পাস আর মিলনায়তন, শহর মিলন কেন্দ্রের মঞ্চ আর পথ নাটকে শহরের বিভিন্ন রাস্তা।
এসব মনে হলেই অভিভাবক হারা হয়ে স্যারকে স্মরণ করি। আঁধার কাটিয়ে আসে আলো। আমবস্যা শেষে পূর্ণিমা। পূর্নিমা এলেই তাকিয়ে থাকি আকাশে, লক্ষ লক্ষ তারা সাজিয়ে রেখেছে পুরো আকাশ, আলোকিত আকাশ তবু অন্ধকার, তাই খোঁজ করি এক হিরন্ময় তারকার। মৌলভীপাড়ার কবিতাঙ্গন,পুরনো উকিল লাইব্রেরীর সাস্কৃতিক চর্চার স্থান নিঃচিহ্ন, খালপাড়ের স্মৃতিস্থান, সড়ক বাজারের শিল্প সাহিত্য চক্র হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। শহর মিলন কেন্দ্র , সুর স¤্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, বর্তমানের শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ভাষা চত্বর নানা ভাবে সেজেছে, শিল্পকলা একাডেমী আধুনিকতার দাবীতে সৌরম্য ভবন হয়েছে,তারকার নাম খুজে পাই না বলেই এত কিছুর মাঝেও অন্ধকার দেখি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী কলেজ, সরকারী মহিলা কলেজ, সুলতানপুরের লায়ন ফিরোজুর রহমান রেসিডেন্সিয়েল একাডেমী, শিশু কিশোরদের পাঠশালা, খেলার মাঠ সবই আছে, আছে তারকার দেয়া নামকরণের সৌধ হিরন্ময়, আছে তারকার প্রিয় সরোদ মঞ্চ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর , শহরের অলিগলি, পথ মাঠ সবই কিন্তু কোথাও খুঁজে পাই না সেই তারকার নাম নিশানা। শখের বাড়ি কবিতাঙ্গনে নেই ফুল ফলের বাগান,স্যারের লেখার স্থান , সেলফের বই, সবুজ ছায়া ঘেরা বাড়িটি কবিতাঙ্গন নামফলক নিঃচিহ্ন।
পাশের তিতাস কন্যা খালটিও মরে গেছে যেন শোকে শোকেই। বীরমুক্তিযোদ্ধা, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষক ছাত্র , রাজনীতিবিদদের পদচারণা নেই মৌলভীপাড়ার খালপাড়ের বাড়ির দিকে। এই বাড়িতে একসময় বসে খেয়ে দীক্ষা নিয়ে অনেকেই সময় কাটিয়েছেন, তারকার আলোরচ্ছটায় আলোকিত হয়েছেন তারাও অনেকে ভুলে গেছেন স্যারকে।স্যার চির শয্যায় শায়িত শেরপুরের কবরস্থানে। ভক্ত ছাত্রদের অনুসারীদের কারো কারো মনে স্যার স্মরণীয় থাকলেও স্যারের কীর্তি নতুন প্রজন্ম জানার মতো কোন নিদর্শনও নেই। স্যার চলে যাওয়ার এক যুগ পরেও বছরে বছরে একই প্রশ্ন, স্যারের যে অবদান তাতে স্যারকে স্মারক করে রাখার দায়বদ্ধতাকে কি আমাদের আছে ? এই প্রশ্ন তাঁদের কাছে যারা ছিলেন স্যারের নানা কিছুর সাক্ষী, স্যারের উৎসাহ অণুপ্রেরণা, নেতৃত্ব আর দীক্ষা পেয়ে সমাজজীবনে ,রাজনীতির মাঠে, সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনে আলোকিত হয়ে আছেন। অনন্য এই হিরন্ময় স্যারকে আগামীর কাছে স্মরণীয় রাখতে কিছু একটা কেউ করবেন এই বিশ্বাস মনে পোষণ করি সবসময়। সেই বিশ্বাস আছে বলেই এবার নতুনত্ব পেয়েছি। একেএম হারুণুর রশীদ স্মৃতি পরিষদের ব্যানারে স্যারের মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে প্রতিবছরই আলোচনা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
এছাড়া লায়ন ফিরোজুর রহমান রেসিডেন্সিয়াল একাডেমি সহ সুর স¤্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন,সাহিত্য একাডেমি, তিতাস সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিল্পী সংসদ কর্মসূচী গ্রহণ করেছে এবার সংযোজন হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিল্পকলা একাডেমী। একযুগ পরে হলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের নিবেদিত প্রাণ স্যারকে আনুষ্ঠানিকতায় স্মরণ করার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এবং শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনের নাম স্যারের নামে করার দাবী জানাচ্ছি।নতুন প্রজন্মের কাছে স্যারকে স্মারক উদ্ভাসিত করার প্রয়োজনীয়তা আছে দেশপ্রেমের দীক্ষার জন্য। নতুনের জন্যই স্যারের সংক্ষিপ্ত তুলে ধরছি। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভা অধিকারী , এই জনপদে এমন আর জন্মাবে কিনা জানা নেই। একে এম হারুনুর রশীদ স্যারের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার খাড়েরা গ্রামে। মৌলভী আবদুল আজিজ রেজিয়া বেগমের এ সন্তানের জন্ম ১৯৪৩ সলের ১ লা জুন।
১৯৬৬ সাল থেকে শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন আমৃত্যু। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একাধারে কবি , সুরকার, গীতিকার, কন্ঠশিল্পী নাট্যকার, নির্দেশক , নাট্যাভিনেতা, দক্ষ শিশু কিশোর সংগঠক, শিল্পী গড়ার কারিগর ছিলেন ছিলেন পুরোধা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ছাত্রছাত্রীদের জন্য ছিলেন আদর্শবান দীক্ষাগুরু। অধ্যাপক একেএম হারনুর রশীদ স্যারের রচিত গ্রন্থের মাঝে রয়েছে তিয়াসা নৃত্য নাট্য, কাব্য গ্রন্থ- সাগরের ঠিকানা শিশিরে শয্যা,আমাকে ক্ষমা করো, আমার ইসলামী ছড়া, প্রবন্ধ মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কৃষ্ণ রমনী ও স্বদেশ কাব্য, নাটক- তবুও আকাশ নীল,সুবর্ণ সংকেত,আউটার সিগন্যাল, আবার শ্লোগান আবার যুদ্ধ, কাব্য নাটক পালা বদলের পালা ইত্যাদী। ২০০৫ সালের ৮ নভেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।স্যারের ১২ তম মৃত্যুবার্সিকীতে গভীর শ্রদ্ধায় স্যারকে স্মরণ করছি।
লেখক ঃ সিনিয়র সহ সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব, সম্পাদক নতুন মাত্রা