দুই জোড়া খুনই অনৈতিক সম্পর্কের কারণে
---
রাজধানীর কাকরাইল ও বাড্ডায় এক রাতে দুটি জোড়া খুনের ঘটনায় অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে পারিবারিক বিরোধই মূল কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।
এর মধ্যে বাড্ডায় বাবা-মেয়ে খুনের ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন তাদেরই বাসায় সাবলেটে থাকা শাহীন মল্লিক ও তার স্ত্রী মাসুমাকে খুলনা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গতকাল শুক্রবার ভোরের দিকে তাদের গ্রেপ্তার করে ঢাকায় আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাড্ডা থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী।
আর কাকরাইলে মা-ছেলেকে হত্যা ঘটনার মামলায় গ্রেপ্তার নিহত শামসুন্নাহারের স্বামী আব্দুল করিম এবং করিমের তৃতীয় স্ত্রী শারমিন মুক্তাকে আদালতের মাধ্যমে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়েছে রমনা থানার পুলিশ।
দুটি জোড়া খুনের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণপদ রায় গতকাল বলেন, দুটি হত্যাকাণ্ডই পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে ঘটেছে। তদন্তে এরই মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। খুব শিগগির দুটি মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করা হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, দুটি জোড়া খুনের কারণ অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। স্ত্রী আর্জিনার পরকীয়া প্রেমের জের ধরেই বাড্ডায় তার স্বামী জামিল ও মেয়ে নুসরাত খুন হয়। এ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মূলত প্রতিবেশী শাহীনের সঙ্গে আর্জিনার পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে পারিবারিক বিরোধে এই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে।
তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, কাকরাইলের ঘটনা ঘটেছে গৃহকর্তা করিমের অনৈতিক সম্পর্কের জের ধরে। এ বিষয়ে তাঁরা অনেকটা নিশ্চিত হলেও খুনিরা ভাড়াটে বলে তাঁদের কাছে তথ্য রয়েছে। তবে খুনিরা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।
গত বুধবার রাতে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ওই দুই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। দুই ঘটনাতেই বৃহস্পতিবার রাতে মামলা করা হয়েছে। কাকরাইলে মা-ছেলে হত্যার ঘটনায় নিহত শামসুন্নাহারের ভাই আশরাফ আলী তিনজনের নাম উল্লেখসহ অজানা কয়েকজনের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করেছেন। ওই তিন আসামি হলো আব্দুল করিম, তার তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তা এবং আল আমিন ওরফে জনি।
এই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এজাহারভুক্ত আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে পূর্বপরিকল্পিতভাবে অজানা খুনিদের সহযোগিতায় শামসুন্নাহার ও ছেলে সাজ্জাদুর করিম শাওনকে হত্যা করেছে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৮ বছর আগে আব্দুল করিম ও শামসুন্নাহারের বিয়ে হয়। এরপর তাদের সংসারে তিনটি ছেলেসন্তান জন্ম নেয়। স্ত্রী ও তিন ছেলে থাকার পরও করিম আরো দুটি বিয়ে করে। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ফরিদা। ওই সংসারে তাদের একটি ছেলেও রয়েছে। তবে ফরিদার সঙ্গে বিয়েবিচ্ছেদ করে করিম তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে শারমিন আক্তার মুক্তাকে বিয়ে করে। এসব নিয়ে বিরোধে শামসুন্নাহারকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত করিম। কয়েক মাস আগে শারমিন আক্তার মুক্তাও কাকরাইলের বাসায় গিয়ে শামসুন্নাহারকে মারধর করে এবং মেরে ফেলার হুমকি দেয়।
মামলার বাদী বলেন, আব্দুল করিম কেবল একাধিক বিয়ে নয়, অনেক মেয়ের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কও চালিয়ে যাচ্ছিল। এসব বিষয়ে শামসুন্নাহার প্রতিবাদ করলে তাঁর ওপর নির্যাতন করা হতো। করিম নিজেও শামসুন্নাহারকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল।
করিম ও তার তৃতীয় স্ত্রী মিলে ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে শামসুন্নাহারকে হত্যা করেছে দাবি করে বাদী আশরাফ আলী আরো বলেন, আব্দুল করিম একসময় খুব গরিব ছিল। পুরান ঢাকায় মাথায় করে সবজি বিক্রি করত। এরপর টাকা-পয়সা হলে সে ক্রমেই খারাপ হতে থাকে।
কাকরাইলে করিমের বাড়ি মায়াকাননের ষষ্ঠতলার ভাড়াটিয়া জাকির হোসেন জানান, একাধিক বিয়ের কারণে শামসুন্নাহারের সঙ্গে তাঁর স্বামীর প্রায়ই ঝগড়া হতো। এ কারণে শামসুন্নাহারকে মারধরও করতেন করিম।
বাড্ডার জোড়া খুন : বাড্ডায় বাবা-মেয়ে হত্যার ঘটনায় নিহত জামিল শেখের ভাই শামীম শেখ বাড্ডা থানায় একটি মামলা করেছেন। এতে জামিলের স্ত্রী আর্জিনা এবং তাদের প্রতিবেশী শাহীনকে আসামি করা হয়।
এই মামলা তদন্তে নেমে পারিবারিক কলহের জের ধরে আর্জিনার সহযোগিতায় তার পরকীয়া প্রেমিক শাহীন হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। বিশেষ করে পরকীয়া সম্পর্ক জেনে যাওয়ায় স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করে আর্জিনা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার আশরাফুল কবির বলেন, বাড্ডায় বাবা-মেয়ে হত্যার ঘটনায় তাদের বাসায় সাবলেট থাকা শাহীন ও তার স্ত্রীকে শুক্রবার ভোরের দিকে খুলনার লবনচড়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পরপরই জামিলের স্ত্রী আর্জিনাকে আটক করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বামী-সন্তানকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার পাশাপাশি শাহীন তাকে সহযোগিতা করেছে বলে জানিয়েছে। তার তথ্যের ভিত্তিতেই মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে শাহীন ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুল কবির বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আর্জিনা জানিয়েছে, আগে থেকেই শাহীনের সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। তারা আগে অন্য একটি বাসায় আলাদা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকত। তখনই তাদের মধ্যে পরকীয়ার সম্পর্ক তৈরি হয়। চার মাস আগে বাসা বদলের সময় আর্জিনাই কৌশল করে শাহীনদের সাবলেট নিয়ে আসে।
আর্জিনা ও শাহীনের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ জানায়, ঘটনার কয়েক দিন আগে আর্জিনা ও শাহীনকে একসঙ্গে দেখে ফেলেন জামিল। এই নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। শাহীনের সঙ্গে আর্জিনার পরকীয়ার বিষয়টি তার মেয়ে নুসরাতও টের পেয়ে যায়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বুধবার রাতে দরজা খোলা রেখে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আর্জিনা। এরপর গভীর রাতে পাশের রুমে সাবলেট থাকা শাহীন এসে আর্জিনার ঘরে ঢুকে তার সহযোগিতায় প্রথমে জামিলকে মাথায় আঘাত করে খুন করে। শিশু নুসরাত ঘটনা দেখে ফেলার কারণে মা আর্জিনার সামনেই শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করে শাহীন।
পুলিশ জানায়, পেশায় রংমিস্ত্রি শাহীন খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবানি সুতাখালী গ্রামের নাজিম উদ্দিন মল্লিকের ছেলে।
আর জামিল শেখ গোপালগঞ্জ সদরের করপাড়া ইউনিয়নের বনপাড়া গ্রামের বেলায়েত শেখের ছেলে। জামিলের পরিবারের লোকজন জানায়, পারিবারিকভাবে প্রায় ১২ বছর আগে জামিল ও আর্জিনার বিয়ে হয়। এরপর মেয়ে নুসরাত ও ছেলে আলভীর জন্ম হয়।
বাড্ডা থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, আর্জিনাকে সঙ্গে নিয়েই শাহীনকে ধরতে অভিযান চালানো হয়। শাহীনকে শনাক্ত করার জন্য তাকে সঙ্গে রাখা হয়েছিল।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের আগে জামিল ও নুসরাতের লাশের সুরতহাল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, জামিলের কপালে একটি ও মাথায় পাঁচটি জখমের চিহ্ন ছিল।
উল্লখ্য, গত বুধবার সন্ধ্যায় কাকরাইলের পাইওনিয়ার গলির ৭৯/১ নম্বর বাসার গৃহকর্তা আবদুল করিমের প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহার করিম ও তাঁর ছেলে শাওনকে ছুরি মেরে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাড্ডার হোসেন মার্কেটের পেছনে ময়নারবাগের একটি বাড়ি থেকে গাড়িচালক জামিল হোসেন (৩৮) ও তাঁর মেয়ে নুসরাতের (৯) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বাবা-মেয়ের লাশ গতকাল গোপালগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে।