পলিথিনের তাঁবুতে করুণ জীবন
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি : ভিটে বাড়িতে পলিথিনের তাঁবু। দেখতে অনেকটা অস্থায়ী বিশ্রামাগার। অর্ধেকে শোবার জন্য চৌকি রাখা। পাশের অর্ধেকে একটি গরু রাখার জায়গা। রোদের তাপ আর বৃষ্টির ফোঁটা সহজেই ভেতরে ঢোকে। নিরাপত্তা নেই বলেই চলে। এমন একটি ঝুঁপড়িতে গত চব্বিশ দিন ধরে রয়েছেন রেহেনা বেগম (কুলসুম) নামে ৬২ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা। পাশের আরেকটা চৌকিতে থাকছে ৩৫ বছরের ছেলে মোশারফ। ১০ বছর বয়সী নাতি আসলামও থাকে তাদের সঙ্গে। শিশু আর নারীসহ তিনজনের থাকার জায়গা এই পলিথিনের একমাত্র ঝুঁপড়িটি।
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের কড়াইল-স্বল্পবড়টিয়া গ্রামে নজরে পড়ল বৃদ্ধার এমন এক আশ্রয়স্থল। সরকার যখন দেশের ঘরহীন মানুষকে বিনামূল্যে ঘর দিচ্ছে সেখানে এমন দৃশ্য অনেকেরই নজর কেড়েছে। নানা শ্রেণিপেশার মানুষ কুলসুমের ঘরটি দেখতে গেলেও কারও মানবিক সাড়া লক্ষ্য করা যায়নি।
সরজমিনে গিয়ে কথা হয় কুলসুমের সঙ্গে। গ্রামের সহজ সরল এই নারী স্বামী হারিয়েছেন বছরখানেক আগে। স্বামীর নাম স্ত্রীর মুখে আনা যাবে না এমন বিশ্বাস এ যুগেও আছে কুলসুমের মধ্যে। অন্যকে দিয়ে স্বামীর নাম জানালেন “সোনা মিয়া”। গত বছরের এই দিনে মারা গেছেন সোনা মিয়া। কথায় কথায় বেরিয়ে এল কুলসুমের অনেক আক্ষেপের কথা।
দিনমুজুর আর মাটি কাটার কাজ করে উপার্জন করতেন সোনা মিয়া। তাদের পরিবার ছিল অসচ্ছল। গত বছর অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যান সোনা মিয়া। এরপর তাদের ছেলে মোশাররফও মাটি কেটে সংসার চালাতো। জোড়াতালির ছোট একটি ঘর থাকলেও অল্প আয়ে সংসার না চলায় ঘরটি বিক্রি করে দেয়। পরে মা, ছেলে, নাতি সবাই চলে যায় টাঙ্গাইল সদরের কাকুয়া চরে মোশারফের শ্বশুর বাড়িতে। মোশারফের স্ত্রী আছমা পরিবারের একমাত্র সম্বল দুটি গরু রেখে মা- ছেলেকে তাড়িয়ে দেয়। কুলসুমের নাতনী মরিয়ম মায়ের কাছে থেকে গেলেও বাবার সঙ্গে চলে আসে শিশু আসলাম। এরপর থেকেই ওই ঝুঁপড়িতে থাকছেন তিনজন।
এমন দৃশ্য দেখেও সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রকার সহযোগিতা মেলেনি কুলসুমের ভাগ্যে। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকেও কোনো প্রকার সহযোগিতা পায়নি কুলসুম। পাননি বয়স্ক ভাতা, ন্যায্যমূল্যের চালের কার্ড কিংবা ভিজিডি কার্ড। তবে প্রতিবেশি আরজু মিয়া ধার হিসেবে একটি টিনের একচালা ঘর করে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবুও ছেলে নাতি আর নিজের জন্য ওটাও যথেষ্ট হবে না।
কুলসুম জানান, ছেলের মাটিকাটার কাজ প্রতিদিন থাকে না। তবুও যা পায় তা দিয়ে সংসার চলে যায়। নাতির সুরক্ষার জন্য হলেও তার একটি ঘরের প্রয়োজন। তার থাকার ঘরের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।
কুলসুমের পলিথিনের ঘরটি স্থানীয়দের নজরে আসলেও বিষয়টি জানা নেই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের। দেউলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কামরুল ইসলাম সাচ্চু জানান, এ বিষয়ে কেউ তাকে কিছু জানাননি।
উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম ফেরদৌস আহমেদ জানান, প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বিনামূল্যে ঘর বিতরণের তালিকা মূলত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও স্থানীয় চেয়ারম্যানের সমন্বয়ে হয়ে থাকে। দেলদুয়ারে প্রায় পাঁচ শ ঘর বিনামমূল্য নির্মাণ হলেও এমন মানুষ বাদ পড়াটা দুঃখজনক। তবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাধ্যমতো সহযোগিতার আশ^াস দেন উপজেলা চেয়ারম্যান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. নাদিরা আখতার জানান, যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দেশের একটি মানুষও না খেয়ে থাকবে না, একটি মানুষ ঘরবিহীন থাকবে না সেখান এমনটা কেন হবে অবশ্যই বিষয়টি দেখবো।
ইউএনও নাদিরা বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। আমি প্রথম দিনই বলেছি এমন মানবিক ঘটনা থাকলে আমাকে জানাবেন। আমি ব্যবস্থা নেব। এখন জানলাম দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ জানার পর তাৎক্ষণিক ওই বাড়িতে লোক পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ঢাকাটাইমস