ইস্তানবুলে চালু হলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিমানবন্দর
ত্রিশ হাজার শ্রমিক আর ২ হাজার ট্রাক ৪০ মাস দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করে তৈরি করলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিমানবন্দরের প্রথম ধাপ। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান যখন বিশ্বের প্রায় ১৭ জন রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ে ইস্তানবুলের নতুন বিমানবন্দর উদ্বোধন করলেন তার ৩ মাস আগেও তুরস্কের অনেকেই বিশ্বাস করতে চায়নি যে এতো বড় একটা প্রকল্প তুর্কিরা এতো অল্প সময়ে শেষ করতে পারবে।
প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের মে মাসে এবং শেষ হওয়ার কথা এ বছরের শেষ নাগাদ। কিন্তু এরদোগান এ বছরের অক্টোবরে শেষ করার জোর তাগিদ দেন।এই সাড়ে তিন বছর সময়ে শুধুমাত্র ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই রাতে ইস্তানবুল এয়ারপোর্টের কাজ থমকে ছিল। ওই রাতে তুরস্কের সেনাবাহিনীর একাংশ সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। কিন্তু জনতার উত্তাল প্রতিবাদ আর এরদোগানের অসীম সাহসের কারণে সেনা ক্যু ব্যর্থ হয়ে যায়। অভ্যুত্থান ঠেকালো ট্রাক!
ওই রাতে ইস্তানবুল বিমানবন্দরে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত সব ট্রাক কাজ রেখে সেনা ব্যারাকের সামনে গিয়ে ট্যাংকগুলিকে আটকে রাখে যেন ব্যারাক থেকে এবার হতে না পারে। অনেক ট্রাক আবার সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবনের ফটকে পাহারা দেয় যাতে ট্যাংক ভেতরে ঢুকতে না পারে।যাহোক ইস্তানবুলের এই নতুন এয়ারপোর্টের কাজ পুরোপুরি শেষ হতে আরো ১০ বছর লাগবে। আর তখন এই বিমানবন্দর হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ। চার ধাপে পুরো নির্মাণ কাজ শেষ হবে।গত সোমবার বিমানবন্দরের যে অংশটুকু উদ্বোধন করা হলো শুধু সে অংশ দিয়েই বছরে ৯ কোটি যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। আর পুরো বিমানবন্দর চালু হলে এর ধারণ ক্ষমতা হবে বছরে ২০ কোটি যাত্রী।
এয়ারপোর্ট কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা বিমানবন্দর ১০.৪ কোটি যাত্রী বহন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দরের খেতাব লাভ করে। এর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের বেইজিং এয়ারপোর্ট, বহন করেছে ৯.৫৭ কোটি যাত্রী। তারপরে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই এয়ারপোর্ট, বহন করেছে ৮.৮২ কোটি যাত্রী। জাপানের টোকিও বিমানবন্দরও ৮.৫৪ কোটি যাত্রী বহন করে বিশ্বের চার নম্বরে স্থান করে নিয়েছে।
এক্ষেত্রে ইস্তানবুল বিমানবন্দর এখনই ৯ কোটি যাত্রী ধারণ ক্ষমতা নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে।আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত এই নতুন বিমানবন্দর থেকে দেশের ভিতরে তিন গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে: আঙ্কারা, আন্তালিয়া এবং ইজমির। আর আন্তর্জাতিক রুটে তুর্কি সাইপ্রাসের এরযান বিমানবন্দর এবং আজারবাইজানের বাকু হায়দার আলিয়েভ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলবে।
ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্তমানের আতাতুর্ক বিমানবন্দর থেকে সব সরঞ্জাম নতুন বিমান বন্দরে সরিয়ে আনা হবে।তুরস্কের রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ৬.৪ কোটিরও বেশি যাত্রী ইস্তানবুলের আতাতুর্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে।
কী আছে ইস্তানবুল বিমানবন্দরে?
নতুন ইস্তানবুল বিমানবন্দরের শুধু টার্মিনালের আয়তনই ১.৩ মিলিয়ন বর্গমিটার। পুরো নির্মাণকাজ করা হবে ৭৬.৫ মিলিয়ন বর্গমিটার জায়গার ওপর। চার ধাপের পুরো কাজ শেষ হলে ৫০০ বিমান ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এপ্রোন এবং ৬টি উড্ডয়ন রানওয়ে থাকবে যা দিয়ে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিমান ওঠানামা করতে পারবে।
বিমানবন্দরে সবচেয়ে আকর্ষণ এবং নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে আসছে এর এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার। টিউলিপ ফুলের আকৃতির এই টাওয়ারটি ২০১৬ সালে ৩৭০ টি প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত তালিকার মধ্য থেকে আন্তর্জাতিক স্থাপত্য পুরস্কার অর্জন করে।
এছাড়াও আছে ৭০ হাজার গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। ২৫০টি বিমান কোম্পানি এখন থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করবে।
সর্বমোট নির্মাণ ব্যায় ২৬ বিলিয়ন ইউরো। প্রথম ধাপের নির্মাণ ব্যায় ৬ মিলিয়ন ইউরো। ৯ হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা পুরো বিমানবন্দরকে নখদর্পনে রাখবে। সাড়ে ৩ হাজার সিকিউরিটি অফিসার দায়িত্বরত থাকবেন।
বিমানবন্দরে আরো থাকবে ৫ শতাধিক বেশি চেক-ইন পয়েন্ট, ২২৮ টি পাসপোর্ট কন্ট্রোল পয়েন্ট, ব্যাগেজ পরিবহনের জন্য ৪২ কিলোমিটার লম্বা ব্যাগেজ সিস্টেম, ১৪৩ যাত্রী উঠার ব্রিজ।
প্রথম ধাপ শেষ হতে সময় লেগেছে মাত্র সাড়ে তিন বছর। বিমানবন্দরের ভেতরে ৫ হাজার বর্গ মাইটার এলাকার ওপর তৈরি করা হয়েছে বিশাল পেট্রল স্টেশন।
বিমানবন্দরটি ইস্তানবুল শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে, কৃষ্ণসাগরের তীরে শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে থাকবে লাক্সারিয়াস বাসের ব্যবস্থা। আগামী বছর থেকে চালু হবে আন্ডারগ্রউন্ড মেট্রো।
শ্রমিক বিক্ষোভ
সর্বমোট ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। তবে এ পর্যন্ত ২৭ জন মারা গেছে। মাস দুয়েক আগে শ্রমিকরা বকেয়া বেতন, অনুন্নত কাজের পরিবেশ, অতিরিক্ত কাজের চাপের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। সরকার অভিযোগগুলোকে আমলে নিয়ে তদন্ত ও পরীক্ষা নিরীক্ষার আশ্বাস দেয়ার পরেও আন্দোলন চলতে থাকলে প্রায় ৪০০ শ্রমিক গ্রেফতার হন।
বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহ বাড়ছে তুরস্ক ভ্রমণে
তুরস্ক আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর একটি। একদিকে যেমন ইতিহাস ঐতিহ্য অন্য দিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেশটিকে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ পিয়াসুদের কাছে করে তুলছে নানন্দিক সৌন্দর্যের অভয়ারন্য।
তুরস্ক ভ্রমণে বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহ ক্রমশই বাড়ছে। এ বছর শেষ হতে না হতেই ইতিমধ্যে মুসলিম প্রধান এ দেশটিতে ভ্রমণ করেছেন ৩ কোটি ২ লাখ বিদেশি পর্যটক। যা গতবারের তুলনায় ২৩ ভাগ বেশি। বুধবার তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদলু এজেন্সিকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানান দেশটির পর্যটন মন্ত্রী মেহমেত নূরী এরসোয়।
পর্যটন মন্ত্রী বলেন, আমরা আশা করি এ বছর তুরস্কের সব রেকর্ড ভেঙে পর্যটক সংখ্যা ৪ কোটি পেরিয়ে যাবে। সামুদ্রিক সৌন্দর্য ও সংস্কৃতি মুসলিম অধ্যুষিত তুরস্ককে বিশেষ অবস্থানে নিয়ে গেছে।