অপরাধ কর্মকাণ্ডে সক্রিয় দুই হাজার বিদেশি
ডেস্ক রিপোর্ট: ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবানের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। মেহমুদ, ওসমান ও ফখরুল হাসান নামের পাকিস্তানের ওই তিন নাগরিকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও বিদেশি নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও পাসপোর্ট না থাকার মামলা হয়। তাদের মধ্যে দুই জন বাংলাদেশে প্রবেশের পরই পাসপোর্ট ফেলে দেয়। আর তৃতীয় জনের কাছ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট উদ্ধার হয়। একই বছরের ৫ অক্টোবর উত্তরায় স্কুল ছাত্র জুবায়েরকে বলাৎকারের পর হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হয় আলজেরীয় নাগরিক আবু ওবায়েদ কাদের। তার কাছে বাংলাদেশে থাকার বৈধ কোনও কাগজপত্র ছিল না।
২০১৫ সালের ৫ জুলাই মাদকদ্রব্যসহ রাজধানীতে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় এক কোরীয় নাগরিক। ২০১৬ সালে ১৩ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরা থেকে চার নাইজেরীয় নাগরিককে আটক করে র্যাব। মুঠোফোনে এসএমএসের (খুদে বার্তা) মাধ্যমে লটারি জেতার নামে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাদের। এ বছরের ৭ মে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার মৈশান মিয়ারবাজার এলাকা গ্রেফতার হয় দুই আফ্রিকান। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় জাল মুদ্রা।
অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস আর অপরাধে জড়িয়ে পড়া বিদেশিদের নিয়ে ওপরের ঘটনাগুলো উদাহরণ মাত্র। বিদেশি অপরাধীদের বিরুদ্ধে ১০০টির মতো মামলা রয়েছে। আর অভিযোগ রয়েছে কমবেশি ২০ হাজার।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অব্যাহত অভিযানও বিদেশিদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে— এই চার শহরে সংঘটিত অনেক সংঘবদ্ধ অপরাধের নেপথ্যে রয়েছে বিদেশিরা। মোট ১৭ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত তারা। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে প্রায় ৫০০ বিদেশি কারাবন্দি থাকলেও তাদের সহযোগিরা এখনও ‘অপরাধ সিন্ডিকেট’ বহাল রেখেছে।
খোদ রাজধানীতেই দেড় হাজার বিদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্য মিলেছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে অপরাধ কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছে আরও ৫০০ বিদেশি। তাদের অন্তত ৩০টি সিন্ডিকেট সক্রিয় বলে ধারণা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, জাপান, স্পেন, জার্মানি, পেরু, তাইওয়ান, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, চীন, নাইজেরিয়া, সুদান, ঘানা, কঙ্গো, তাঞ্জানিয়া, উগান্ডা ও ক্যামেরুন— এই ২২ দেশের নাগরিকদের এখন পর্যন্ত অধরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
রাজধানীর ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, কলাবাগান, মিরপুর, পল্লবী, খিলক্ষেত, শেওড়া, নিকুঞ্জ, বনশ্রী, উত্তরা, গুলশান, বনানী ও বারিধারা— মূলত এসব এলাকায় বিদেশিরা বসবাস করে। তবে ঘন ঘন বাসা পরিবর্তন করে তারা। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ—এসবি, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন—র্যাব, অপরাধ তদন্ত বিভাগ—সিআইডি ও গোয়েন্দা পুলিশ—ডিবি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পুলিশের সূত্রগুলো জানায়, তিনটি ক্যাটাগরিতে জরিপ চালিয়ে অপরাধের সঙ্গে জড়িত বিদেশিদের শনাক্ত করা হয়েছে। ক্যাটাগরিগুলো হলো— ভিসা এক্সপায়ার্ড বা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও অবস্থান), ক্রিমিনাল (নানা ধরনের অপরাধে সরাসরি জড়িত) এবং গভর্নমেন্ট ডিজায়ার (সরকারি চাহিদায় অবস্থান)।
সূত্রগুলো বলছে, বিদেশিদের অনেকে নিজ দেশের পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে বাংলাদেশি জাল পাসপোর্ট ও জাল ন্যাশনাল আইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) ব্যবহার করছে। অনেকে আবার ভোটার তালিকাতেও নাম তুলেছে। বাংলাদেশি নাগরিক বিয়ে করে নাগরিক বনে যাওয়ার চেষ্টাও করছে অনেকে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশিদের বাংলাদেশে প্রবেশ ও প্রবেশ-পরবর্তী কর্মকাণ্ড তদারকিতে ইমিগ্রেশন বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু তা যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে না। তবে পুলিশের দাবি, বিদেশিদের অপরাধ দমনে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘এখানে যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত আছে তাদের একটা অংশ নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও এখানে থেকে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এদের অধিকাংশই মাদক, পতিতাবৃত্তি ও মানবপাচারের মতো অপরাধগুলো করছে। এসব আমাদের যুব সমাজ থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্রই অস্থিরতা তৈরি করছে।’
ড. জিয়া রহমান মনে করেন, ইমিগ্রেশন সিস্টেমটা আমাদের এখানে সব সময়ই দুর্বল। বিদেশিরা বাংলাদেশে ঢোকার পর কোথায় থাকছে, কী করছে, ঠিকানা পরিবর্তন করে কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে— এ বিষয়গুলোর খুব বেশি তদারকি হয় না। ফলে প্রশাসনিক দুর্বলতা আর ঘুষ-দুর্নীতির মতো বিষয় কাজে লাগিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে বিদেশিরা। বিদেশিদের অপরাধ কর্মকাণ্ড কমাতে এ দিকগুলোতে নজর দেওয়া জরুরি বলে মত দেন তিনি।
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ‘বিদেশিদের কর্মকাণ্ডের ওপর সব সময়ই নজরদারি থাকে। যারা অপরাধে জড়িত আছে তাদের গ্রেফতারে অভিযানও অব্যাহত আছে। আর অভিযান চলছে বলেই গ্রেফতারও হচ্ছে বিদেশি অপরাধীরা।’ সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের সহযোগিতা নিয়ে বিদেশি অপরাধী বা অবৈধভাবে বসবাসকারীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়ে ৪৭৪ জন বিদেশি দেশের বিভিন্ন কারাগারে আছে। এর মধ্যে অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় সাজা হওয়া ৫১ জন এবং বিভিন্ন মামলায় আটক হয়ে হাজতি হিসেবে কারাবন্দি ৪২৩ জন।
বিভিন্ন মামলায় সাজা পেয়ে কারাবন্দি আছে মিয়ানমারের ২৪ জন, ভারতের ১৩ জন, পাকিস্তানের ৯ জন, মালয়েশিয়ার তিনজন ও তাঞ্জানিয়ার দুইজন। আর হাজতি হিসেবে বন্দি আছে মিয়ানমারের ২৭৭ জন, ভারতের ১০৭ জন, পাকিস্তানের ১৯ জন, নাইজেরিয়ার ছয়জন, মালয়েশিয়ার তিনজন, জাপানের তিনজন, পেরুর দুইজন, কঙ্গোর দুইজন, সোমালিয়ার দুইজন, আলজেরিয়ার এক জন, ক্যামেরুনের একজন, স্পেনের একজন ও জার্মানির একজন।
বিদেশিদের বিরুদ্ধে মূলত ১৭ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্য রয়েছে। সেগুলো হলো— ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদ, পর্নোগ্রাফি, সোনা চোরাচালান, সাইবার প্রতারণা (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রেম-বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফটোশপের মাধ্যমে তৈরি করা আপত্তিকর ছবি আপলোডের ভয় দেখিয়ে), অস্ত্র ব্যবসা, মানবপাচার, পতিতাবৃত্তি, মাদক চোরাচালান, জাল মুদ্রার ব্যবসা, হুন্ডি ব্যবসা, এটিএম কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া, মুঠোফোনে এসএমএস দিয়ে লটারি জেতার কথা বলে প্রতারণা, অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ ও ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল—ভিওআইপি ব্যবসা। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন