৬ই নভেম্বর, ২০১৬ ইং, রবিবার ২২শে কার্তিক, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ


দিপালীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা


Amaderbrahmanbaria.com : - ০৪.১১.২০১৬

মাত্র কদিন আগেই না ঘুরে এলাম গোল্লা গোবিন্দপুর, নবাবগঞ্জের দোহার থেকে। ঘুরে ঘুরে লক্ষ্মীপুজো দেখলাম, মণ্ডপে গেলাম, লুচি, লাবড়া, শুক্তো, নাড়ু খেলাম। প্রতিমার সঙ্গে সেলফি তুললাম। খুব বড় বড় কথা বললাম, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। আমরা সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করি। লোকে ভীষণ বাহবা দিল আমাকে। বিশাল এক স্কুল মাঠে শিশুদের আরতি নৃত্যের প্রতিযোগিতার পুরস্কারও দেওয়ালো আমার হাতে তুলে। আড্ডা-গল্পে পার হলো রাত। আর এবার শ্যামা পুজোয় বন্ধু জয়ন্ত বলেছিল, চলে আয় আমাদের এখানে, কালী বিসর্জনের রাতে মজা হবে ভীষণ। নিজেই বলেছিলাম, যদি আসি, হোক বেসুরো, মঙ্গল দ্বীপ জেলে গাইব, শুনতে হবে কিন্তু। সেই আমারই আজ লজ্জায়, ঘৃণায়, অনুতাপে খাক হয়ে যাবার উপক্রম। কী করে মুখ দেখাব আমি রতনের কাছে, সুব্রতের কাছে, সুভাষের কাছে। কী বলব বারীন, অনিমেষ, অরুণা, দীপালী, দিলীপের কাছে? ফেসবুকেও বসি না, ইনবক্সে অজয় দাস গুপ্তের টেক্সট। এত না দাদা দাদা করে আমি অস্থির, দাদা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি বলে এখান থেকে সুদূর সিডনিতে দাদার বুকে আছড়ে পড়ি, আহলাদ করি, কত আবদার আমার তার কাছে। লজ্জা। লজ্জা। লজ্জা। আমি শেষ হয়ে যাই।

২.
লোকগুলো বোকা। আমি হয়তো আরো বোকা। বোকা না হলে ওদের বোকা কেন ভাবছি, আমি। যে দেশে লোকে চাঁদে সাঈদীর ছবি বিশ্বাস করে, সেখানে অমন ঘটনা, ঝাঁপিয়ে পড়বে না তো পড়বে কোন ভূ-স্বর্গে। এখনও, উৎকর্ষ প্রযুক্তির এই দিনেও ধর্মের কথা বলে, বিশ্বাসের কথা বলে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হানাহানি, খুনোখুনি, রক্তারক্তিÑ সবই সম্ভব এ দেশে। এক হিন্দু তরুণ পবিত্র কাবার ব্যঙ্গচিত্র পোস্ট করেছে ফেসবুকে। খোঁজ নিয়ে যা জানলাম, শুনলাম, বুঝলাম যা তা হলোÑ তার ফেসবুক আইডি’টি কয়েকটি আইপি এড্রেস থেকে খোলা হতো। সে জানত না। যখন জেনেছে, বিষ্ফোরণ যখন চারদিকে, ক্ষমা চেয়েছে সে সকলের কাছে। কিন্তু রেহাই পায়নি, নিস্তার মেলেনি সাধারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। বাড়ির পর বাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট। নিষ্পাপ দেবীমূর্তি আছড়ে পড়েছে, ছিটকে পড়েছে উঠোনে, রাস্তায়, দিকবিদিক। পাথরে, লাঠি পেটায় মানুষের অন্তরের বিশ্বাসে রক্তের দাগ লেগেছে ছিটকে।

৩.
আমাদের একটি দার্শনিক দারিদ্র্য রয়েছে। কেবল সারফেস থেকে দেখি আমরা কোনো ঘটনাকে, ভেতরে প্রবেশ করি না। সাদা চোখে যা দেখা যায়, বোঝা যায় যা, তাই বিশ্বাস করি। এই ঘটনাটিকে নেহাত এক তরুণের ধর্মীয় অবমাননা হিসেবে দেখবার সুযোগ নেই। সুযোগ রয়েছে আরো গভীরে যাবার, আরো তল স্পর্শ করার। যে ছেলেটি পোস্ট দিয়েছে সে তো খুব সাধারণ এক জেলে তরুণ। অশিক্ষিত। আইটিও বোঝে না সে। অথচ ছবিটি ফটোশপ করা। ছেলেটি কি আগেও এমন বা এ ধরনের পোস্ট দিয়েছে, সে কি ইসলামবিদ্বেষী পূর্ব থেকেই, এমন কোন প্রমাণ কি গেছে পাওয়া? তার ফেসবুক আইডি আরো কারা কারা খুলত, কেন খুলত, তারা কারা? কি তাদের উদ্দেশ্য, স্বার্থ, সে সবও তো ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। এই সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা কখন ঘটেছে, কোন সময়ে, যখন বাংলাদেশ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে আরো বেশি উচ্চতার দিকে বেগবান তখনই তো? দেশে আরো বেশি বিনিয়োগ আসতে শুরু করেছে। ভারতের সঙ্গে সু-সম্পর্ক, চায়নার সঙ্গে বন্ধুত্ব, বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি যখন বাস্তব চেহারা পেতে যাচ্ছে তখন কিছু মানুষ দিশেহারা। জঙ্গি হামলায়ও বাংলাদেশ জিরো টলারেন্স অবস্থান নিয়েছে। বিশ্বের কাছে এদেশ এখন ক্রমশ উন্নয়ন আর উন্নতির মডেল প্রায়। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ পার করছে প্রায় সুস্থির একটি সময়। প্রস্তুতি নিচ্ছে সব দল, সারাদেশ আগামী নির্বাচনের। এমন যখন পরিবেশ প্রতিবেশ, শৃঙ্খলা যখন দৃশ্যমান, তখনই অদৃশ্য কিছু মানুষ ও অপশক্তি চায় বিশৃঙ্খলা। চায় উস্কানি। মানুষের ধর্মানুভূতির চেয়ে নরম, স্পর্শকাতর জায়গা আর একটিও সম্ভবত নেই। ফলে আঘাত করো সেখানে। উস্কানি দাও। দাবানলের মতো জ্বলবে আগুন । মনে আছে নিশ্চয়ই, রামুতে যেমনটি ঘটেছিল।

প্রশাসনের আচরণ কম রহস্যপূর্ণ নয়। অদ্ভুত নীরবতা লক্ষ্য করা গেছে। ওসিসহ পুলিশ ও প্রশাসনের অনেকেরই মধ্যে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এমনিতেই তুলনামূলকভাবে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা সক্রিয়। সেখানকার ধর্মান্ধ মানুষদের নানা মাত্রার নাশকতার অভিজ্ঞতা, কমবেশি জানা অনেকের। সেটি জানবার পরও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও খাটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতো দুটো দলকে সমাবেশের অনুমতি কেন দিলো প্রশাসন? কেন শিথিলতা ছিল, কেন মণ্ডপে, মন্দিরে নিরাপত্তা অপ্রতুলতা দৃশ্যমান। তবে কি ধর্মীয় অবমাননা, উস্কানির অভিযোগ সবই উপলক্ষ্য মাত্র। এমন তো নয়, অন্য কেউ বা কারা ভিতরে ভিতরে সক্রিয়?

৪.
ধর্ম আমার বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের অনুভুতিতে কেউ যেন আঘাত না করে। অন্যের অনুভুতিও তেমনি একই। অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা আছে বলেই। চাই অন্যে আমাকে শ্রদ্ধা করুক, তাই শ্রদ্ধা করি অন্যকে। অবমাননা যদি কেউ করে থাকে তবে তার দায়, একান্ত তারই। সে দায় নিতে হবে তাকেই, সে যেই হোক, প্রকৃত তদন্ত সাপেক্ষে। গ্রামের পর গ্রাম, বাড়ীর পর বাড়ী জ্বালাও পোড়াও, ভাংচুর, লুন্ঠন, সন্ত্রাস ভিন্ন আর কিছু নয়। সভ্যতার এতটাকাল পেরিয়ে এসে যেকারো, যেকোনো ধর্মের অবমাননা, কটাক্ষ, সংঘাত, দ্বন্দ্ব-এ বড় লজ্জার।

মনে রাখতে হবে, বিশ্বাস বড় ব্যক্তিগত, বিশ্বাস যার যার।

পুনশ্চ : লেখাটি যখন লিখছি, দিপালীর ফোন। দিপালী আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু। অস্ট্রেলিয়া থাকে, পোস্টডক করছে। যার পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়ীয়া। এবার পুজোর সময় আসবার কথা ছিল, আসতে পারেনি, ব্যস্ততায়। দিপালী ফোন করে কাদঁছে। আমি চুপ করে থাকি । কি বলব, জানি না। দিপালী, আমায় ক্ষমা করে দিও। দিপালীদের কাছে ক্ষমা চাই আমি।

লেখক : সাংবাদিক ও সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।





Loading...


প্রকাশকঃ মোঃ আশ্রাফুর রহমান রাসেল
সম্পাদক : বিশ্বজিত পাল বাবু
চেয়ারম্যান : আলহাজ্ব নুরুজ্জামান
ঠিকানা : ৬০৩ ফুলবাড়িয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
email : [email protected] (news)
Phone: +880851 62307
+8801963094563


close