সোমবার, ২৭শে আগস্ট, ২০১৮ ইং ১২ই ভাদ্র, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

কবে ফিরবেন ভিটেয়, অপেক্ষায় রোহিঙ্গারা

টেকনাফ প্রতিনিধি: রহিমা খাতুনের বয়স ৬০। মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযানে প্রাণ গেছে তার স্বামীর। ওই সময় তাদের ঘরবাড়িও পুড়ে ছারখার হয়েছে। মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি, তার ছেলে ও নাতি। এরপর পাহাড়-জঙ্গল-নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আসা তাদের। এদেশে এসে আশ্রয় পেয়েছেন; অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসারও ব্যবস্থা হয়েছে। গত একবছর আশ্রয় শিবিরে ত্রাণে-দানে ভালোই কাটিয়েছেন। কিন্তু এখন নিজ ভিটেয় ফিরতে চান; সামনে অনিশ্চিত জীবনের দুশ্চিন্তা থাকার পরও।

রহিমা খাতুন জানান, নিজ ভিটের কথা মনে উঠলে হাহাকার করে উঠে তার বুক; অজান্তে চোখ ভিজে যায় জলে। নিজ দেশের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তবু নিজ ভিটেয় ফেরার প্রহর গুনে দিন কাটছে।

গত সোমবার (২০ আগস্ট) দুপুরে কক্সবাজারের টেকনাফের মৌচনি লবণ মাঠে রোহিঙ্গা শিবিরে গেলে এসব কথা জানান মিয়ানমারের বুথিডং এলাকার নারী রহিমা খাতুন। এসময় হালিমা আক্তার নামের এক রোহিঙ্গা বৃদ্ধার সঙ্গেও কথা হয়, যার বাড়ি মিয়ানমারের মংডুর হাসসুরাত গ্রামে। হালিমা আক্তারও জানান, কবে ভিটেয় ফিরবেন –এ অপেক্ষায় দিন গুনচ্ছেন এখন।

হালিমা আক্তার জানান, ঈদ আনন্দের বদলে বেদনা নিয়ে আসে তার দরজায়। গত বছরের আগস্টে কোরবানি ঈদের সময়েই তিনি ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে।

তিনি আরও জানান, হাসসুরাত গ্রামে কাঠের তৈরি দোতলা বাড়ি ছিল তার। সেখানে তাদের ১২ একর জমি আছে, আছে ৩ একর চিংড়িঘের। কোরবানির সময় বাজার থেকে তাদের গরু কিনতে হতো না। কারণ, তাদের নিজেদের গরু-মহিষের খামার ছিল।

হালিমা আক্তার জানান, গত বছরের শেষের দিকে বিকালে তাদের গ্রামে হামলা চালায় সেনাদের একটি দল। ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন তার এলাকার অনেকে ঘরবাড়ি থেকে বের হতে না পারায় আগুনে পুড়ে মারা যায়।

তিনি জানান, সেদিন ৬ সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে আসার সময়, অনেক বাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখেন। এক বাড়ির জানালা থেকে তিন জন নারীকে ‘বাঁচাও-বাঁচাও’ বলে চিৎকার করতে শুনেন। সে দিনের সেই ঘটনাগুলো এখনও তাকে তাড়া করে।

তিনি বলেন, ‘এত কিছুর পরও যে দেশে জন্মেছি, সেদেশেই মরতে চাই। কবে যে ওপারে যাবো –সে অপেক্ষায় দুই চোখে ঘুম আসে না রাতে। ওপারে স্বামীর কবরের পাশে শেষ ঘুম ঘুমাতে চাই।’

রাখাইনের মংডুর বড়গজি বিল এলাকা থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন শাহিদা বেগম (৩০)। গত বছরের সেপ্টেম্বরে টেকনাফের জাদিমুড়া পাহাড়ে আশ্রয় নেন তিনি। শাহিদা জানান, ওই সময় তার স্বামী দিলু মিয়াকে ধরে যায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাকে পরে আর পাওয়া যায়নি। তিনি মেয়ে ও চার ছেলেকে নিয়ে লম্বাকিল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তার স্বামী যে মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন তা পুড়িয়ে দেয় সেনাবাহিনী।

শাহিদা বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, স্বামীকে ফিরে পাবো। সেজন্য রাখাইনে ফিরতে চাই। কিন্তু কবে ফিরতে পারবো, জানি না।’

উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান মো. ফয়েজু বলেন, ‘মিয়ানমারে আমার গর্জন কাঠের তৈরি একটি দোতলা বাড়ি ছিল। এখানে একটি ছোট ভাঙা ঝুপড়িতে কোনোরকমে আছি। নিজ দেশে ফিরতে চাই, তবে মিয়ানমারের নাগরিক স্বীকৃতি নিয়ে।’

টেকনাফ শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান রমিদা বেগম বলেন, ‘গহীন পাহাড়ের ভেতরে গড়ে উঠেছে এই রোহিঙ্গা শিবির। এখানে ২০ হাজার মানুষের বসবাস। তার মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা আছেন, যারা মিয়ানমারে অবস্থাপন্ন ছিলেন। অনেকের অবস্থা আবার ভালোও ছিল না। কিন্তু শেষমেশ সবাই-ই নিজের দেশে ফিরতে চায়।’

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) প্রণয় চাকমা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সরকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঝুপড়িতে থাকা রোহিঙ্গাদের ভাঙা ঘরগুলো এনজিওদের মাধ্যমে ভালো করে নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে।’

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার। এ অভিযানে সেনাবাহিনীর সহিংসতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেন রোহিঙ্গারা, নতুন-পুরনো মিলিয়ে যার সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। এসব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দফায় দফায় মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানায়। উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় প্রত্যাবাসন চুক্তিও। তবে রোহিঙ্গারা কবে ফিরতে পারবে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বাংলাট্রিবিউন