ইসলাম ধর্মে সড়কের নিরাপত্তা
ডেস্ক রিপোর্ট : একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে মানবজীবনের সব সমস্যারই সমাধান দিয়েছে ইসলাম ধর্ম। মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য মনোনীত এমন একটি দ্বিন ইসলাম ধর্ম, যা শুধু কিছু ইবাদত-আকিদার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর বিধানাবলি জীবনের সব বিষয় শামিল করে।
রাস্তায় চলাচল করা যেহেতু জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই এর নিরাপত্তার জন্যও ইসলামের নির্দেশনা রয়েছে। সড়ককে নিরাপদ করতে একদিকে প্রতিটি নাগরিককে সচেতন হয়ে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বিষয় সড়ানোর নির্দেশের পাশাপাশি কোনো চালক বা অন্য কারো ত্রুটির ফলে কেউ নিহত হলে সে চালক কিংবা অপরাধীর শাস্তির বিধানও রেখেছে ইসলাম।
সড়কে চলাচলের অধিকার সবার আছে, কিন্তু এ সড়ক কারোর একার নয়, বরং সবার। একজন মুমিন সড়কে তার নিজের অধিকারের ব্যাপারে যেমন সচেতন থাকবে, তেমনি অন্যের অধিকারের ব্যাপারেও সচেতন থাকবে। সড়ককে এমনভাবে ব্যবহার করতে পারবে না, যেন তার এ ব্যবহার অন্যের ভোগান্তির কারণ হয়। এমন কিছু সড়কে ফেলে রাখতে পারবে না, যা অন্যের কষ্টের কারণ হয়। নিজে তো ফেলবেই না, বরং কষ্টদায়ক কোনো বস্তু পড়ে থাকলে সে তা সরিয়ে দিয়ে রাস্তা নিরাপদ করবে।
রাস্তা নিরাপদকরণের এ বিষয়টি ঈমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ঈমানের পরিচায়ক। এ প্রসঙ্গে নবীজি (সা.) বলেন, ‘ঈমানের ৭০টিরও বেশি শাখা আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান শাখা হলো, এ কথার স্বীকৃতি দেওয়া যে আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আর সবচেয়ে নিচের শাখাটি হলো রাস্তায় কোনো কষ্টদায়ক বস্তু থাকলে তা সরিয়ে দেওয়া।’ (সহিহ বুখারি : ৯; সহিহ মুসলিম : ৩৫)
চলাচলের অনুপযোগী ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চালানো শুধু কষ্টদায়কই নয়; বরং তা রীতিমতো মানুষের প্রাণের জন্য হুমকিরও কারণ। ইচ্ছা করে রাস্তায় এমন গাড়ি চালানো ঈমানের বিপরীত। ফলের খোসা, ময়লা, উচ্ছিষ্ট খাবার, দুর্গন্ধ ছড়ায় এমন কোনো জিনিস ইচ্ছাকৃতভাবে রাস্তায় ফেলে রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায়। এসব ফেলে রাখলে মারাত্মক গুনাহ হবে। পক্ষান্তরে এসব বস্তু রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলে তা সরিয়ে দিলে সদকার সওয়াব লাভ করতে পারবে একজন মুসলিম নাগরিক।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, মানুষের ওপর প্রতিদিন তার শরীরের প্রতিটি গ্রন্থির জন্য সদকা দেওয়া আবশ্যক। …রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়াও একটি সদকা।’ (সহিহ মুসলিম : ১১৮১)
রাস্তা থেকে এ ধরনের কষ্টদায়ক বস্তু সরানো মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও জান্নাত পাওয়ার অসিলা হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘একবার রাস্তার ওপর একটি গাছের ডাল পড়ে ছিল, যা মানুষের জন্য কষ্টদায়ক ছিল, অত:পর এক লোক তা সরিয়ে দিল। এর ফলে আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করেছেন।’ (সহিহ বুখারি : ৬২৪)
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি এক ব্যক্তিকে জান্নাতের লাল গালিচায় গড়াগড়ি খেতে দেখলাম। (জান্নাতে তার এ পুরস্কার লাভের কারণ) মানুষের চলাচলের পথে একটি গাছ ছিল, যার কারণে চলাচলে কষ্ট হচ্ছিল। ওই ব্যক্তি তা কেটে দিয়েছিল (ফলে আল্লাহ খুশি হয়ে তাকে জান্নাতে এ পুরস্কার দান করেন)।’ (সহিহ মুসলিম : ১৯১৪)
অবৈধভাবে দখলের ফলে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় অনেক সময় বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তা দখলের ব্যাপারে নবীজি (সা.) কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘খবরদার! তোমরা রাস্তায় বসে থেকে রাস্তা দখল করবে না। একান্ত যদি বসতেই হয়, তাহলে রাস্তার হক আদায় করবে।’ (সহিহ বুখারি : ২২৯৭; সহিহ মুসলিম : ৩৯৭২)
অর্থাৎ রাস্তা দখল তো করবেই না, একান্ত যদি কিছু সময়ের জন্য বসতেই হয়, তাহলে এমনভাবে বসতে হবে, যেন অন্যের কোনো রকম কষ্ট না হয় এবং রাস্তায় স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব (রাস্তার হক) পালন করতে হবে। অনেক সময় গাড়ি পার্কিংয়ের ফলেও অন্যের কষ্ট হয়। দোকানপাটের সামনে এমনভাবে গাড়ি রাখা হয়, যার ফলে দোকানে গ্রাহক আসতে পারে না বা আসতে কষ্ট হয়। তাই রাস্তায় কষ্টদায়ক কাজের মধ্যে সাইকেল, মোটরসাইকেল, গাড়ি পার্কিং করার শামিল। যেখানে পার্কিংয়ের অনুমতি আছে, সেখানে গাড়ি রাখলেও এমনভাবে রাখতে হবে, যেন এর দ্বারা অন্যের কষ্ট না হয়।
একজন মুসলমানের পথচলার দ্বারা অন্য কারো যেন কষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একজন ড্রাইভারকে এমনভাবে গাড়ি চালাতে হবে, যেন কোনো মানুষ ও প্রাণী কষ্ট না পায়। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় বেরিয়ে অন্যকে কষ্ট দেওয়া, বেআইনিভাবে লেন পরিবর্তন করা অথবা গতিসীমা অতিক্রম করে অন্যের নিরাপত্তাহীনতা কিংবা কষ্টের কারণ হওয়া মুমিনের কাজ নয়। অন্যের কষ্টের কারণ হওয়া থেকে যে ব্যক্তি নিজেকে বিরত না রাখে, সে মুসলমান হয় কী করে! রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান তো সে-ই, যার জবান ও হাত থেকে অন্য মুসলমানরা নিরাপদ থাকে।’ (সহিহ বুখারি : ১০)
মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তা নিরাপদ করতে কিছু কাজে উৎসাহ দিয়েছে ইসলাম। এগুলো রাস্তার হক। যেমন সড়কে চলতে গিয়ে কখনো রাস্তা হারিয়ে বিপদে পড়ে যান অনেকে। কোনো পথচারীকে এ সমস্যা থেকে উদ্ধারে রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া রাস্তার হক। এর দ্বারা লাভ করা যাবে সদকার সওয়াব। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি কাউকে তার অচেনা পথ দেখিয়ে দিলে তা তোমার জন্য একটি সদকা।’ (ইবনে হিব্বান : ৫৩৪)
অন্য হাদিসে কাউকে পথ দেখিয়ে দেওয়াকে গোলাম আজাদ করার সওয়াব লাভের মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো দুগ্ধবতী বকরি দান করে অথবা কাউকে ঋণস্বরূপ অর্থ প্রদান করে কিংবা কাউকে পথ দেখিয়ে দেয়, সে একটি গোলাম আজাদ করার সওয়াব লাভ করেবে।’ (জামে তিরমিজি : ১৯৫৭)
কেউ রাস্তায় জুলুমের শিকার কিংবা বিপদের সম্মুখীন হলে তার সাহায্যে এগিয়ে আসাও রাস্তার হক। অন্ধ, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের রাস্তা পারাপারে সহযোগিতা করে মহান আল্লাহর সাহায্য লাভ করা যায়। কেউ রাস্তায় অত্যাচারিত হলে এবং কেউ দুর্ঘটনা কিংবা বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসা মুমিনের কর্তব্য। কারণ, অপর ভাইকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলে মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুসলমানরা পরস্পর ভাই ভাই। কেউ কারো প্রতি জুলুম করবে না এবং শত্রুর কাছে হস্তান্তর করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে কোনো মুসলমানের একটি কষ্ট লাঘব করবে, আল্লাহ তার কিয়ামতের দিনের একটি কষ্ট লাঘব করবেন। (সহিহ বুখারি : ২৩১০)
কোনো পথচারী বোঝা তুলতে গিয়ে কষ্টের মুখোমুখি হলে তাকে বোঝা উঠিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করা রাস্তার হক। অনেক সময় দেখা যায়, একজন যাত্রী তার জিনিসপত্র গাড়িতে উঠাতে পারছেন না। অল্প সময়ে তার সামানা ওঠানোর কাজে সহযোগিতা করে সদকার সওয়াব লাভ করা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তিকে সাওয়ারিতে ওঠানো বা তার সামানা বহনে সহযোগিতা করাও একটি সদকা।’ (বুখারি : ২৮২৭)
এ ছাড়া চক্ষু অবনত করা, কাউকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করা-সবারই এমন সব হক আদায় করা কর্তব্য।
প্রত্যেক নাগরিকই ‘অন্যকে কষ্ট দেব না’-এ মর্মে যদি অঙ্গীকার করে এবং রাস্তার সব হক আদায় করে, তাহলে আমাদের সড়ক হবে নিরাপদ।
লেখক: খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ, বোর্ড বাজার, গাজীপুর।
(লেখাটি ডেইলি বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত)