১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে নিকষ কালোদিন, সভ্যতা ও মানবতাকে হত্যার দিন। বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু যিনি বাঙালি জাতির ভাগ্য উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক মুক্তির জন্য বাঙালি জাতিকে শুনিয়েছেন স্বাধীনতার মন্ত্র“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” দেশের জন্য, জনগণের জন্য কত যে ঝুঁকি নিয়েছেন! জেল-জুলুম-হুলিয়া উপেক্ষা করে বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, নিজ চোখে অবলোকন করেছেন মানুষের দুঃখ-বেদনা, অন্যায়-অবিচার। জীবনের সোনালি ১৪টি বছর কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। বাঙালির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তাদের তিন সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, দশ বছরের শিশু শেখ রাসেল, শেখ কামাল ও শেখ জামালের স্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের ও নিরাপত্তা কর্মীসহ ১১ জনকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ঘাতকরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় হত্যাকা- থেকে বেঁচে যান। ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের নিষ্ঠুরতা পৃথিবীর ইতিহাসের সকল নিষ্ঠুরতাকে ছাড়িয়ে গেছে, নারী, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, পঙ্গু ব্যক্তিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সাক্ষীদের জবানবন্দি শুনে গা শিউরে ওঠেছে, খুনিদের গুলিতে ১০ বছরের শিশু রাসেলের চোখ ও মাথার মগজ বেরিয়ে যায়, কী ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা! বঙ্গবন্ধুর জ্যৈষ্ঠ পুত্র শেখ কামালকে হত্যার মধ্য দিয়ে খুনিরা এ বর্বরতম হত্যাকা- শুরু করে এবং কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলকে হত্যা করে এই নারকীয় যজ্ঞ শেষ করে। খুনিরা বঙ্গবন্ধুর জ্যৈষ্ঠ পুত্র শেখ কামালকে নিচতলায় অভ্যর্থনা কক্ষে, সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুকে, বেগম মুজিবসহ অন্যদের শয়নকক্ষে গুলি করে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতা শেখ নাসের পানি বলে আকুতি জানালে তাকে বাথরুমে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। শেখ রাসেল ‘মায়ের কাছে যাব’ বলে কান্নাকাটি করলে একজন ঘাতক তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যেতে বলে। অতঃপর শিশু রাসেলকে দোতলায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। যে ঘাতক রাসেলকে মায়ের কাছে নিতে বলেছিল সেই ঘাতকই কিছুক্ষণ আগে বেগম মুজিবকে হত্যা করে এসেছে। মানবতার সাথে, একজন শিশুর সাথে এমন নির্দয় আচরণ বিশ্ব সভ্যতার আর কোথাও ঘটেছে কি-না আমার জানা নেই। মামলার বাদী এএফএম মহিতুল ইসলাম আদালতে বলেছেন, আমার ধারণা ছিল ঘাতকরা অন্তত শিশু রাসেলকে হত্যা করবে না, সেই ধারণাতেই আমি রাসেলকে বলিÑ ‘না ভাইয়া তোমাকে মারবে না।’ বাদী আদালতে বলেন, গেটে অবস্থানরত মেজর বজলুল হুদাকে মেজর ফারুক (ফারুক রহমান) কী যেন জিজ্ঞাসা করেন, তখন মেজর বজলুল হুদা বলে All are finished. বঙ্গবন্ধুর ও তার পরিবার আমৃত্যু ত্যাগ নির্ভীকতার সাথে মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। এই নৃশংস হত্যাকা-ের সময় বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ খুনিদের কাছে প্রাণভিক্ষা চান নি, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে থাকতে দেখে খুনিদের বলেছেন ‘তোমরা এখানেই আমাকে মেরে ফেল।’ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকের দল নিষ্ঠুরতা বন্ধ করেনি, বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফন নিয়ে খুনিদের ভেতর ভয় কাজ করেছে। ১৬ আগস্ট বেলা ২টায় হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নেওয়া হয়। গোসল ও কাফন ছাড়া লাশ দাফন করতে চায় ঘাতকরাÑ প্রতিবাদে গর্জে ওঠে টুঙ্গিপাড়ার সাহসী সন্তানরা, গোসল ও কাফন ছাড়া তারা লাশ দাফন করতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। পরে মাত্র ১০ মিনিট সময় দেওয়া হয়। আবদুল মান্নাফ, ইমানউদ্দিন গাজী, নুরুল হক শেখ, কেরামত আলী অপার ভালোবাসায় তাদের প্রিয় ‘খোকা’কে ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করান। আবদুল হাই শেখ ও মৌলভি আবদুল হালিম কাফনের কাপড় বানান। মৌলভি আবদুল হালিম বঙ্গবন্ধুর জানাজা পড়ান। মা-বাবার কবরের পশ্চিম পাশে বঙ্গবন্ধুকে সমাহিত করা হয় শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, চোখের জলে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে খুনি মোশতাক নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে, ২০ আগস্ট মার্শাল ল’ জারি করে, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৫ আগস্টের খুনিদের দায়মুক্তির জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বন্ধ করে দেয় এই হত্যাকা-ের বিচারের পথ। খুনিদের বিচারে সোপর্দ না করে পুরস্কৃত করা হয়, বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়। এই নৃশংস ঘটনার পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত খুনিদের সুরক্ষা করেছে, প্রটেকশন দিয়েছে প্রতিটি সরকার। খুনিরা সদম্ভে খুনের কথা স্বীকার করে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছে। ২৬.০৫.১৯৭৬ সালে খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান ’৭৫-এর আগস্টের হত্যাকা-ের ব্যাপারে সানডে টাইমস পত্রিকার ১১নং পৃষ্ঠায় একটি বিবৃতি প্রদান করে, যার শিরোনাম I helped to kill Mujib dare you put me on trail. সাংবাদিক এখনই মাসকারেনহাসের কাছে দেওয়া খুনি ফারুক ও রশিদের সাক্ষাৎকারের সাথে সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত বক্তব্যের সাদৃশ্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় চতুর জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সাক্ষী ও আসামিদের জবানবন্দিতে স্পষ্ট হয়েছে এভাবেÑ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, পরে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে। জিয়া এসব কিছুই করে বন্দুকের নল দেখিয়ে, জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্সকে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করে খুনিদের সুরক্ষা দেখার ফলেই খুনিরা দম্ভভরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার কথা স্বীকার করে সাক্ষাৎকার প্রদান করে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল বিচার আদালতে সাক্ষ্য দেন, ১৫ আগস্ট সকাল অনুমান ৬টায় মেজর রশিদ তাকে বলে We have captured state power under Khandakar Mustaque, Sheikh is killed, do not try to take any action against us. এ কথা শুনে শাফায়াত জামিল হতচকিত হন। দ্রুত ইউনিফরম পরে হেড কোয়ার্টারের দিকে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় যান এবং তাকে শেভরত অবস্থায় পান, জিয়াউর রহমান শাফায়াত জামিলকে বলেন,ÔSo what president is killed… . খুনি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলে, ‘… এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের সাথে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয় এবং সে মতে এপ্রিল মাসের এক রাতে তার বাসায় আমি যাই…, আলোচনা হয় এবং সাজেশন চাইলে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘তোমরা করতে পারলে কিছু কর।’ পরে আমি রশিদের বাসায় গিয়ে জিয়ার মতামত তাকে জানাই। রশিদ তখন বলে, ‘এ বিষয় নিয়া তোমাকে চিন্তা করতে হবে না… আমি deal করব।’ রশিদ পরে জিয়া এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদের সাথে যোগাযোগ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি জিয়াউর রহমান, ক্রিটিক্যাল জিয়া ’৭৫-এর নৃশংস হত্যাকা-ের আর্কিটেক্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর দীর্ঘ ২১ বছর বিচারের বাণী কেঁদেছিল, বিচারহীনতার সংস্কৃতি পাথরের মতো চেপে বসেছিল বাঙালির বুকে, বিশ্ব সভ্যতায় বাঙালি জাতির ললাটে এঁকে দিয়েছিল কলঙ্ক তিলক। সভ্যতার ইতিহাস থেকে পাঠ নিয়েছি আব্রাহাম লিংকনকে হত্যার পর তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন নয়, ইন্দিরা গান্ধী হত্যার চার বছরের কম সময়ের মধ্যে, মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শুরু করতেই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ২১ বছর এবং ৩৪ বছর পর কার্যকর হয়েছে আংশিক বিচার। মূলত ’৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত গণতন্ত্র বন্দী ছিল, আইনের শাসন ছিল অনুপস্থিত। ’৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা সরকার গঠন করার পর সংসদে আইন পাস করে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিত করা হয়Ñ যাত্রা শুরু হয় কলঙ্ক মোচনের। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটির বিচার সম্পন্ন করার জন্য ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুলের আদালত ’৯৭ সালের ৩ মার্চ মামলার নথিপ্রাপ্ত হন। দায়রা মামলা নং-৩১৯/১৯৯৭ শিরোনাম রাষ্ট্র বনাম লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান (অব.) এবং অন্য ১৯ জন। তদন্তকারী অফিসার আবদুল কাহার আকন্দ দ-বিধির ১২০- বি/৩০২/১৪৯/৩২৪/৩৪/৩০৭/২০১/৩৮০/১০৯ ধারায় নি¤œলিখিত ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র নং-০৭, তাং- ১৫.০১.১৯৯৭ আদালতে দাখিল করেন। আসামিদের নাম লে. কর্নেল ফারুক রহমান (অব.), লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ, অনারারি ক্যাপ্টেন আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার, মিসেস জোবায়দা রশিদ (১-৬নং আসামিরা গ্রেফতারকৃত ও জেলহাজতে রয়েছে), লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর মো. বজলুল হুদা (আর্টিলারী), লে. কর্নেল এসএইচএসবি নূর চৌধুরী ইবি, লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম বিইউ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল মো. আবদুল আজিজ পাশা, বিএ লে. কর্নেল এমএ রাশেদ চৌধুরী, মেজর একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ, রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ওরফে মোসলেমউদ্দিন ওরফে হীরণ খান ওরফে মোসলেমউদ্দিন খান ওরফে রফিকুল ইসলাম খান, মেজর আহাম্মদ শরীফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার, ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ, দফাদার মারফত আলী, এলডি মো. আবুল হোসেন মৃধা (পলাতক) ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ ওপরে উল্লেখিত ২০ আসামির বিরুদ্ধে দ-বিধির ১২০(বি) এবং দ-বিধির ৩০২/৩৪ ধারা এবং দ-বিধির ২০১ ধারা মোতাবেক ৩-দফা বিশিষ্ট অভিযোগ গঠন করা হয়। মৃত (১) খন্দকার মোশতাক আহমেদ (২) মাহবুবুল আলম চাষী (৩) বিজেও ১৮১০ রিসালদার সৈয়দ ছরোয়ার হোসেন (৪) ক্যাপ্টেন এম মোস্তফা আহম্মদের নাম চার্জ গঠন থেকে বাদ দেওয়া হয়। বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ৬১ সাক্ষী বিচারিক আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন। আলামত ও জব্দ তালিকা যেদিন আদালতে প্রদর্শন করা হয় চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর পরনের সাদা পাঞ্জাবিতে ১৫টি, চেক লুঙ্গিতে ১৮টি, বেগম মুজিবের ব্লাউজের পেছনে ১৩টি বুলেটের ছিদ্র দেখে মনে হচ্ছিল আমার আত্মাটাই বুঝি অসংখ্য ছিদ্র হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ঘাতকের নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পায়নি কবি নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’Ñ যার ভেতর ঝুলে আছে ঘাতকের বুলেট। কবি নজরুল এটি দেখলে কী বলতেন জানতে ইচ্ছে করে! শিশু রাসেলের রক্তমাখা নীল শার্ট, বেগম মুজিবের পরনের লাল পাড়ের সাদা রক্তমাখা শাড়িটি প্রায়ই চোখে ভাসে। মামলাটিকে প্রলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত করার জন্য আসামিপক্ষ ও তাদের দোসররা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। বিচারিক আদালত সকল প্রকার আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। আসামিÑ ১. লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ২. লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ৩. লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ৪. পলাতক আসামি লে. কর্নেল আবদুর রশিদ ৫. পলাতক আসামি মেজর বজলুল হুদা ৬. পলাতক আসামি লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম ৭. পলাতক আসামি মেজর শরিফুল হোসেন ওরফে শরফুল হোসেন ৮. পলাতক আসামি লে. কর্নেল এএম রাশেদ চৌধুরী ৯. পলাতক আসামি লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) ১০. পলাতক আসামি লে. কর্নেল এসএইচএসবি নূর চৌধুরী ১১. পলাতক আসামি লে. কর্নেল আবদুল আজিজ পাশা ১২. পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাসেম ১৩. পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার ১৪. পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ১৫. পলাতক আসামি রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ওরফে মোসলেমউদ্দিনকে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে দ-বিধির ৩০২/৩৪ ধারায় অপরাধের জন্য ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মৃত্যুদ- প্রদান করেন। জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শুধু সুরক্ষা বা পুরস্কৃতই করেনি, সভ্যতা ভব্যতাকে পাশ কাটিয়ে আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জিয়ার স্ত্রী বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন হরতাল পালন করেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনি রশিদকে এমপি বানিয়ে, সংসদে বিরোধী দলের নেতা বানিয়ে পবিত্র সংসদকে কলুষিত করেছে। খুনির দল বিএনপি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিতকরণকল্পে আনীত বিলটি উত্থাপনের দিন সংসদে অনুপস্থিত থেকে প্রমাণ করেছে এই হত্যাকা-ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের যোগসূত্রতা রয়েছে। ২০০১-এর অক্টোবরে প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি-জামাত জোট সরকার গঠন করে। আইনের চলমান প্রক্রিয়া বন্দী হয় রাজাকারের প্রকোষ্ঠে। পরবর্তীতে হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চে ও তৃতীয় বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি সম্পন্ন হয়। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর কারাবন্দী আপিলকারীÑ ১. মেজর মো. বজলুল হুদা ২. লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ৩. লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ৪. লে. কর্নেল মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) ৫. মেজর একেএম মহিউদ্দিন আহমেদের (ল্যান্সার) লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন আদালত। ২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়। টানা ২৯ দিন শুনানি চলে, আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল এই মামলায় সুপ্রিম কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করার। মনে পড়ে ১৯ নভেম্বর, ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। রায় ঘোষণার দিন ১নং বিচারকক্ষে ছিল উপচেপড়া ভিড়। ১১টা ৫৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতি এজলাসে আসন গ্রহণ করেন এবং সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শুরু করেন। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বলা হয়, লিভ টু আপিল মঞ্জুরের প্রথম যুক্তি ছিল হাইকোর্টের দ্বিধা বিভক্ত রায় নিষ্পত্তিতে তৃতীয় বিচারপতি পুরো রায় বিবেচনা না করে ছয়জনের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে আইনের ব্যত্যয় বা মৌলিক ভুল করেছেন কি-না? এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারা মোতাবেক হাইকোর্টের তৃতীয় বিচারপতি কোন কোন বিষয় বিবেচনায় নিতে এবং শুনতে পারবেন এটি সম্পূর্ণ তার স্বাধীনতা। তাই বিচারপতি কোনো ভুল করেন নি। দ্বিতীয় যুক্তি মামলা দায়েরে ‘বিলম্ব’ স্বাভাবিক বলে নি¤œ আদালতের পর্যবেক্ষণ যথার্থ কি-না? এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মত হলো মামলা দায়েরে বিলম্ব অযৌক্তিক নয়। তৃতীয় যুক্তি বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ঘটনা ‘সেনাবিদ্রোহ’ না নিছক হত্যাকা- এবং অভিযুক্তদের সাধারণ আদালতে বিচার করার এখতিয়ার রয়েছে কি? এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের অভিমত সেনা আইনের ৫৯-এর ২ ধারায় বলা হয়েছে, হত্যাকারী যদি অ্যাকটিভ সার্ভিসে থাকে তা হলে সেনা আইনে বিচার করা হবে। আপিলকারীরা কেউই অ্যাকটিভ সার্ভিসে ছিল না। চতুর্থ যুক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকা-ের ঘটনাটি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের আওতায় পড়ে কি? এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ হলো এটা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্র ছিল। পঞ্চম যুক্তি রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনিÑ সুপ্রিম কোর্টের অভিমত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণ নি¤œ আদালতের রায় বহাল রেখেছেন। আসামিপক্ষ যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন। উপরোক্ত যুক্তিগুলো বিবেচনায় সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কারাবন্দী আসামিদের দায়ের করা আপিলগুলো খারিজ করেন। একই সঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করেন। আপিলকারী পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করে মৃত্যুদ- বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্ট, আপিলকারীদের ছাড়াও নি¤œ আদালতের দ-প্রাপ্ত বাকি সাতজনসহ মোট ১২ জনের মৃত্যুদ- বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের ১৫৫ দিন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চে ৬৬ দিন এবং আপিল শুনানি হয়েছে ২৯ দিন। সুপ্রিম কোর্টের ৪১২ পৃষ্ঠার রায়ে মোট শব্দ সংখ্যা ১ লাখ ৫৭ হাজার ১২৯টি। আইনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কারাবন্দী আসামিদের সাজা কার্যকর করা হয়। জাতি একটি কলঙ্ক থেকে আংশিকভাবে মুক্ত হয়। বস্তুত আমাদের লড়াইটি এখনও রয়ে গেছে। পালিয়ে থাকা মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বাকি খুনিদের দ- কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটতেই থাকবে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করতেই খুনিরা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ করেছে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গ, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, শিশু শুকান্ত বাবুকে হত্যা করে মানবতার বুকে কুঠারাঘাত করেছে। খুনিরা শুধু একজন নেতাকে নয়, জাতির পিতাকে হত্যা করেছে। একটি আদর্শকে হত্যা করেছে। এই নারকীয় ঘটনায় রাষ্ট্র তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি, বিচারের পদক্ষেপ নেয়নি; বরং খুনিদের পুরস্কৃত করে, দায়মুক্তি দিয়ে সারাবিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছিল খুনির রাষ্ট্রে। একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের একটি যোগসূত্র রয়েছে, সম্পর্ক রয়েছে। আসামি ফারুক রহমান ও আবদুর রশিদ সম্পর্কে ভায়রা ভাই, বজলুল হুদার ভগ্নিপতি আজিজ পাশা, মেজর ডালিম ও নূর চৌধুরী ঘনিষ্ঠ বন্ধু, খোন্দকার আবদুর রশিদ খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে। আওয়ামী লীগ আইনের শাসনে বিশ্বাস করে। তাই কোনো প্রতিশোধের পথ পরিহার করে আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই ঐতিহাসিক মামলাটি পরিচালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা এই গভীর শোক সামলে কীভাবে দিনযাপন করেন ভেবে মাঝে মধ্যেই আশ্চর্য হই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। এই চেতনা ধারণ করে কাজ করলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রতি বর্ষায়, প্রতি বসন্তে, শরতের পেঁজাতুলা মেঘে, মায়াবী জোছনায়, টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়ায়, রাজপথের ঝাঁঝালো মিছিলে বঙ্গবন্ধু বিরাজ করেন নিরন্তর। বঙ্গবন্ধু অমর, বঙ্গবন্ধু অক্ষয়, বঙ্গবন্ধু অব্যয়।
লেখক : সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও আইনজীবী