গল্পটা প্রথম নারী মেজর জেনারেল সুসানে গীতির
অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক পথ। নিজের মেধা, অধ্যবসায় আর পেশার প্রতি অদম্য আনুগত্যের ওপর ভর করে ক্যারিয়ারে অর্জন করেছেন আরেকটি তিলক। সেটা হলো মেজর জেনারেল। মেডিকেল কলেজের একজন পরিচালকের কর্মকাণ্ড দেখে অনুপ্রাণীত হয়েছেন। আর সবচেয়ে ভালো বেসেছেন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত জীবন। পরে ওই জীবনকে নিজের জীবনের সঙ্গে করেছেন একাকার। গল্পটা বাংলাদেশের প্রথম নারী মেজর জেনারেল ডা. সুসানে গীতির।
৩০শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম নারী মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান তিনি।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সামছুল হক ওইদিন সেনা সদর দপ্তরে তাকে মেজর জেনারেল পদবির র্যাংক ব্যাজ পরিয়ে দেন। তার স্বামী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুল্লাহ মো. হোসেন সাদ (অবসরপ্রাপ্ত) একজন সফল সামরিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। মেজর জেনারেল সুসানে গীতি ১৯৮৫ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারী ডাক্তার হিসেবে ক্যাপ্টেন পদবিতে যোগদান করেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম নারী হিসেবে হেমাটোলজ্থিতে এফসিপিএস ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন এবং বিভিন্ন সামরিক হাসপাতালে প্যাথলজি বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি মানবজমিনসহ আরো কয়েকটি গণমাধ্যমের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার ক্যারিয়ারের নানা দিক।
নিজের নামের ব্যাখা দিয়ে বলেন, আমার নাম রেখেছিলেন আমার নানা। এটা একটি ফারসি নাম। উচ্চারণটা আসলে সাউসান-ই-গীতি। গীতি মানে পৃথিবী আর সাউসান হচ্ছে একটি ফুল। এর অর্থ হচ্ছে পৃথিবীর ফুল। বোর্ডের তালিকায় নামটা সুসানে হয়ে যায়। পরে সেটা আর কারেকশন করা হয়নি। রাজশাহীতে বেড়ে ওঠা সুসানে গীতি বলেন, এ পর্যন্ত আসতে আমার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমার মা’র। আবার নানীও অনেক অবদান রেখেছেন। ক্যারিয়ারে আরেকটি পদক প্রাপ্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে খুবই ভালো লাগছে। বিশেষ করে যে কোন নতুন কিছু শুরু করার মধ্যে একটা অন্যরকম আনন্দ থাকে। সেক্ষেত্রে আমাকে দিয়ে শুরু হয়েছে। এজন্য আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। নারী ক্ষমতায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ। কাজ করতে গিয়ে আমি নারী না পুরুষ তা নিয়ে বিভেদ আনতে চাই না। কাজের ক্ষেত্রে আমি আমার কাজটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। যেটা আমার কাজ সেটাই করেছি। এ পর্যায় আসতে কি ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রশ্নে তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ তো কিছু থাকেই। আমাদের কার্যক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আসতে হয়। যেমন আমি একজন প্যাথলজি স্পেশালিস্ট। এ কারণে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিংয়ে যেতে হয়েছে। বড় বড় সিএমএইচ চালাতে হয়েছে। এসব কিছু চ্যালেঞ্জের সঙ্গে নিতে হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের সেনাবাহিনীর সিস্টেম অন্যরকম। আমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয় সেটা পালন করতে আমি বাধ্য।
দায়িত্বটা আমরা সূচারুরূপে পালন করে থাকি। কাজ করতে গিয়ে সামাজিক ও পারিবারিক কোন বাধার মুখে পড়েননি বলে জানান তিনি। নারীর ক্ষমতায়নের অংশ হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাগুলোতে নারীর সংখ্যা বাড়ছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা অবশ্যই একটি বিরাট পজিটিভ দিক। সামগ্রিকভাবে আমরা অনেক পিছিয়ে ছিলাম। সেক্ষেত্রে আমাদের নারীর ক্ষমতায়ন চলছে কিছুদিন ধরেই। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর অবদান অনেক। এসব কারণে আমাদের উন্নয়ন আরো এগিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। দেশ আরো উন্নত হবে। কেননা একজন শিক্ষিত মা শিক্ষিত সমাজ উপহার দেবে। একটা শিক্ষিত সমাজ যখন চলে আসবে তখন দেশের উন্নয়নে এটা আরো কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সেনাবাহিনীতে আসার গল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত জীবন, শৃঙ্খলা, তাদের কর্তব্যবোধ আমাকে অনুপ্রাণীত করেছে। মেডিকেল কলেজের একজন ডাইরেক্টর ছিলেন। উনি আর্মি থেকে এসেছিলেন। স্যার খুব সুন্দরভাবে কলেজ পরিচালনা করতেন। সেগুলো দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিলো। তাই ইন্টার্নি পিরিয়ড থেকে সেনাবাহিনীতে আসার আবেদন করি। আমাদের আর্মি মেডিকেল কোরে কিন্তু সেনাবাহিনীতে অনেক আগে থেকেই চিকিৎসক আছেন। এটা পাকিস্তান আমল থেকেই আছে। কর্ণেল রোকেয়া আনিস ম্যাডাম ছিলেন।
উনি প্রথম কর্নেল ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুরাইয়া রহমান ছিলেন। উনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতেই প্রথম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হয়েছিলেন। বর্তমানে আমাদের দেশের নারীদের অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে নারীরা অনেক জায়গায় এগিয়ে গেছে। অনেক সাংবাদিক এখন নারী। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা মহিলা। বিভিন্ন সেক্টরে যেমন এডমিন ক্যাডারে মহিলা আছেন। আইন সংস্থাতেও অনেক মহিলা আছেন। সে হিসেবে আমরা কিন্তু অনেক এগিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে আরো এগিয়ে যাবো। সেক্ষেত্রে কি আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি যে আগামীতে সেনাপ্রধান হতে যাচ্ছেন একজন নারী-এমন প্রশ্নে অনেকটা অট্টহাসি দিয়ে তিনি বলেন, হতেও পারে। কারণ আমাদের অন্যান্য কোরেও তো আর্মিতে মহিলারা এসেছেন। এরই মধ্যে অনেকের লে. কর্নেল পদে আসার সুযোগ আসছে। সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ি অবশ্যই তারা প্রমোশন পাবে। মেজর জেনালের হওয়ার পর কি ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন প্রশ্নে তিনি জানান, মানুষ যত উপরে উঠবে তার দায়িত্বও তত বাড়বে। আমার কাছে এখন বড় দায়িত্ব হচ্ছে পেশাগত জ্ঞান দিয়ে সেবার মান আরো উন্নত করা।
জাতিসংঘ মিশনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, মিশনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সবাই খুব পছন্দ করে। জেন্ডার বেসিসে অনেক মহিলা এখন মিশনে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল কন্টিনজেন্টে (ব্যানমেড) মেডিকেল কোর থেকে আমরা প্রথম গিয়েছিলাম। অন্যান্য আর্মস কোর থেকেও এখন যাচ্ছেন। তিনি বলেন, সেখানে আমরা ফ্রি ফ্রাইডে ক্লিনিক পরিচালনা করতাম। গ্রামে গ্রামে যেয়ে তাদেরকে চিকিৎসা দিয়ে বেড়াতাম। বাংলাদেশ তাদের কাছে খুবই পছন্দের। প্রতিটি মানুষ কিন্তু বাংলাদেশকে পছন্দ করতো। তারা এত ভালোবাসতো যে আমাদের কাছে এসে তারা বাংলাও শিখতো। তারা অনেক কালচারাল শো করেছে, আপনারা দেখেছেন। বাংলায় তারা গান গেয়েছে। এখন সেখানে যারা আছেন আশা করি আমাদের থেকেও তারা ভালো করবেন। সেনাবাহিনীতে যারা নতুন আসতে চায় তাদের জন্য কি পরামর্শ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বি ডেডিকেটেড টু ইউর সার্ভিস। আমরা যেহেতু মেডিকেল সার্ভিসে আছি সেক্ষেত্রে রোগীদের সেবাটা আরো ভালো করে দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশ নিয়ে নিজের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যাক।
বিশেষ করে আমি একজন শহীদ পরিবারের সন্তান। আমি চাই, আমার বাবার রক্ত যেনো বৃথা না যায়। আমার বাবা শহীদ খলিলুর রহমান রাজশাহীতে পুলিশ অফিসার ছিলেন। তিনি পাকিস্তান আর্মির হাতে মারা যান। আমরা তার ডেডবডিটা পাইনি। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জন্য আমাদের ফিলিংসটা অন্যরকম। আমরা আরো উন্নতি চাই এদেশের। আমার এই পজিশনে থেকে আমাকে আদর্শ ভেবে আরো অন্যরা যেনো এগিয়ে আসে আমি সেটাই চাই। নিজের পরিবারের অবদান প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার স্বামী সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার। একটি ফ্যামিলিতে হাজবেন্ড ও ওয়াইফ দু’জনে দু’জনার ভালো না চাইলে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসতে পারে না। বাচ্চাদেরও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সবারই অবদান আছে। সূত্র:- মানবজমিন।