মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার ল্যাম্পপোস্টের তার আবারও চুরি
ডেস্ক রিপোর্ট : ১৫টি র্যাম্প নিয়ে চার লেনের মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার। নগরবাসীকে যানজট থেকে মুক্তি দিতে প্রায় ৯ কিলোমিটার ফ্লাইওভারটি খুলে দেয়া হয় গেল বছরের ২৬ অক্টোবর। কিন্তু উদ্বোধনের পর থেকে কিছু চোর রীতিমতো খামছে ধরে খাচ্ছে ফ্লাইওভারটি। দিনে-দুপুরে ফ্লাইওভারের দেয়াল ভেঙে ও ফুটো করে চুরি হচ্ছে বৈদ্যুতিক তার। ফলে একে একে নিভে গেছে ফ্লাইওভারের বাতির সারি। রাতে পুরো ফ্লাইওভারই অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।
ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের একমাত্র ভরসা গাড়ির হেডলাইট। ফলে দুর্ঘটনা এড়াতে ফ্লাইওভারটির ব্যবহারই কমিয়ে দিয়েছে অনেকে। তার চুরির ফলে মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের পৃথক দুটি ট্রাফিক সিগন্যাল প্রায় ৮ মাসের বেশি সময় ধরে অকেজো হয়ে আছে। এতে যানবাহন চলাচলের সময় প্রায়ই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে, বড় দুর্ঘটনারও শঙ্কা থেকে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
গেল শনিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, পুরো ফ্লাইওভারে একটি বাতিও জ্বলছে না। পরদিন রোববার পুরো ফ্লাইওভারে অনুসন্ধান চালিয়ে যা দেখা যায়, তাতে রীতিমতো গা শিউরে উঠার মতো অবস্থা।
পুরো ফ্লাইওভার প্রায় তিন শতাধিকের বেশি ল্যাম্প রয়েছে। যার মধ্যে ১১০টি ল্যাম্পপোস্টের নিচে গর্ত করে তার চুরি করে নেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রায় শতাধিক ল্যাম্পপোস্টের নিচে রয়েছে নতুন প্লাস্টার। যাতে তার চুরি হয়েছে কিনা তা দেখা যায়নি। এছাড়া পুরো ফ্লাইওভারে প্রায় ৫ শতাধিকের বেশি গর্ত রয়েছে। শুধু তার চুরি নয় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণের বক্স খুলে নেয়া হয়েছে সকেটও। ল্যাম্পপোস্ট থেকেও খুলে নেয়া হয়েছে সকেট। ফ্লাইওভারের ল্যাম্পপোস্টের নিচে গর্ত করার সময় পড়ে থাকা প্লাস্টার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরো ফ্লাইওভারে। দেখে যেন মনে হয় খুবই প্লান করে গর্ত তৈরি করা হয়েছে। শুধু গর্ত নয়, গর্ত তৈরি করে ল্যাম্পপোস্টের পাইপ ও ওয়ারিং এর পাইপের তারও নিয়ে নেয়া হয়েছে।
এশিয়া প্যাসেফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল আলম শুভ বলেন, ফ্লাইওভারে ল্যাম্পপোস্ট থেকে তার চুরি খুব সহজ বিষয় নয়। বিদ্যুৎ সম্পর্কে জানাশোনা ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব এমন দুঃসাহসের।
মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক ও এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুশান্ত কুমার পাল আরটিভি অনলাইনকে বলেন, ফ্লাইওভারটি দেখাশোনার জন্য আমরা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে মৌখিক স্বীকৃতি দিয়েছি। সীমা নির্ধারণ নিয়ে দুই সিটি করপোরেশন আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যা অমীমাংসিত রয়েছে। এজন্য তারা দায়িত্বভার নেয়ার জন্য কাগজপত্রে এখনও সই করছে না।
অধিকাংশ ল্যাম্প পোস্টের নিচে গর্ত করে তার কেটে চুরি করা হচ্ছে। ফ্লাইওভারে সিসি ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও এভাবে তার চুরির হচ্ছে কিভাবে? মূলত ফ্লাইওভারটি এখন দায়িত্বভার কার কাঁধে রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফ্লাইওভারটি সরকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি। মানুষ উপকৃত হচ্ছে কিন্তু চলাচল করছে ঝুঁকির মধ্যে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ অক্টোবর ফ্লাইওভারটি উদ্বোধন করে যান চলাচলের জন্য পুরোপুরি খুলে দেয়া হয়। তখন আমরা ফ্লাইওভারটি চলাচলের জন্য পুরোপুরি ওকে করে দিয়েছিলাম। সিগন্যাল বাতিগুলো ঠিক ছিল, ল্যাম্প পোস্টের বাতিগুলোও সচল ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন পর্যায়ে তার চুরি হয়ে যায় বিভিন্ন স্থানে। আমরা ঠিকাদারকে অনুরোধ করেছি।
এরপর চুরি হওয়া স্থানে এ পর্যন্ত চারবার তার লাগিয়ে দেয় ঠিকাদার কোম্পানি। কিন্তু তারা কতবার লাগিয়ে দেবে? চুরির দায়িত্ব ঠিকাদার নিবে না। যা আমাদের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে নাই। আমরা ঠিকাদারের সাথে এমন কোনও চুক্তি করি নাই যে তারা দেখভাল করবে, নিরাপত্তা দেবে, মেরামত করে দেবে। এই প্রকল্পতে যেটা বলা আছে সেটা হলো ফ্লাইওভারটির কমপ্লিট করার পর সিটি করপোরেশনের কাছে তা হস্তান্তর হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী যান চলাচলের জন্য উদ্বোধন করার পর মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দুই সিটি করপোরেশনকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেখাশোনার জন্য চিঠি দিয়ে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা পরিচালনা করবেন তাদের বুয়েটের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ফ্লাইওভারটি তিনটি কন্ট্রাক্টে তৈরি হয়েছে। তেজগাঁও থেকে হলি ফ্যামিলি একটা কন্টাক্ট, স্কাটন থেকে মৌচাক পর্যন্ত একটি কন্টাক্ট, শান্তিনগর থেকে রামপুরা হয়ে একটি কন্টাক্ট রয়েছে। শান্তিনগর থেকে রামপুরায় এর আগে দুইবার তার চুরি হয়েছে যার সাথে সংযুক্ত রয়েছে ট্রাফিক সিগন্যালটি। একেকবার তার চুরিতে দশ থেকে ১২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। চুক্তির অজুহাতে সিটি করপোরেশন ফ্লাইওভারটি দায়িত্ব না নেয়ার কারণে ফ্লাইওভারটির লাইফটাইম কমে যাচ্ছে। রুটিন মাফিক দেখভালটা প্রতিনিয়ত করা দরকার।
ফ্লাইওভারটি দায়িত্ব কেন নেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মো. জামাল মোস্তফা বলেন, ফ্লাইওভার নিয়ে মন্ত্রণালয়ের (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়) সঙ্গে আলাপ আলোচনা চলছে। মন্ত্রণালয় যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে সে অনুসারে আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করব। যদি মন্ত্রণালয় বলে ঢাকা উত্তর পুরো ফ্লাইওভার দেখবে তাতেও আমাদের আপত্তি নেই।
ফ্লাইওভারটির দায়িত্ব কেন নেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মাদ বিলাল আরটিভি অনলাইনকে বলেন, মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে বসবে এর পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে ফ্লাইওভারটি কিভাবে দেখাশোনা করা হবে। কারণ সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, এলজিইডি, ডিএমপি, বিদ্যুৎ এ প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট।
প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের পর থেকে সিটি করপোরেশনের কাঁধে দায়িত্ব পরে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা দেখছি মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ফ্লাইওভারটি দেখাশোনা একটি কারিগরি বিষয়। ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিভাবে মেরামত হবে, কারা মেরামত করবে। আইন বুঝে নেয়া। এটা তো টেকনিক্যাল বিষয়। কারণ এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে আরেক প্রতিষ্ঠান দেখভাল করবে। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ও পলিসির ওপর নির্ভর করবে কে ফ্লাইওভারটি দেখভাল করবে।
নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এতদিন ধরে ফ্লাইওভারের বাতি জ্বলে না, সিগন্যাল বাতি জ্বলে না, মানুষ ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে। আর এখানে কে দেখবে না দেখবে এ নিয়ে রশি টানাটানি চলছে। এটা প্রশাসনিক, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার পরিচয়, আমরা গ্রহণ করতে রাজি নই। দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকা দরকার। সুশাসন ও আন্তরিকতার প্রয়োজন।
এক হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারটি গেল বছরে ২৬ অক্টোবর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করে যান চলাচলের জন্য পুরোপুরি খুলে দেন। আরটিভি অনলাইন