ঘর থেকে বের হওয়ার রাস্তা নেই, লাশ বের হলো কারাগার দিয়ে!
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যায় ফায়ার সাভির্সের কর্মীরা জেলা কারাগারের সীমানা প্রাচীরের ওপর দিয়ে মরদেহ বের করছে। এমন করুণ ঘটনা নরসিংদীর ভেলানগর স্টেডিয়াম এলাকার।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাত্র ১০ ইঞ্চি সরু একটি পথ দিয়ে চলাচল করতো একটি পরিবার। এর ফলে ওই পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও হাসপাতালে নেয়া যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন একই পরিবারের দুই জন।
এ বিষয়ে কথা হয় নিহত আহসানের ভাবি ও শাখাওয়াত হোসেনের স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, বাড়িটি যখন কেনা হয়েছিল তখন তিন দিক দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা ছিল। ৫/ ৬ বছরের মধ্যে বাড়ির চারপাশে স্থাপনা গড়ে তোলেন বিত্তশালীরা। এর মধ্যে বাড়ির ঠিক সামনে এন.কে.এম. হাই স্কুল অ্যান্ড হোমস স্কুলের অডিটরিয়াম স্থাপন করা হয়।যাতায়াতের রাস্তার জন্য স্কুলের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির মোল্লার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, ‘বাড়ির ভেতর থেকে তিন হাত জায়গা ছেড়ে দিলে রাস্তার জন্য দুই হাত জায়গা দেবেন।’
আনোয়ারা বেগম বলেন, আমরা সাফকাওলা দলিলের মাধ্যমে জায়গা বিনিময়ের কথা বলেছিলাম। কিন্তু তিনি রাজি হননি। অপর পাশের বাড়ির মালিককেও বলেছিলাম তারাও জায়গা ছাড়তে রাজি হয়নি। একইসঙ্গে পৌর কর্তৃপক্ষের শরণাপন্নও হয়েছিলাম, তারাও কোনো সমাধান দিতে পারেনি। তাই ১০ ইঞ্চি সর পথ দিয়েই আমাদেরকে চলতে হচ্ছে।উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা এ এইচ এম জামেরী হাসান বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। এখন যেহেতু নজরে এসেছে, আমরা এর আশাপাশে যারা জড়িত আছে, সে সব পক্ষকে নিয়ে স্থায়ী একটি সমাধান দেয়ার চেষ্টা করবো।
জানা যায়, প্রায় ২০ বছর পূর্বে শাখাওয়াত হোসেন নরসিংদীর ভেলানগর এলাকায় দুই লাখ চল্লিশ হাজার টাকায় সাড়ে তিন শতাংশ জমি ক্রয় করেন। ওই জমিতে আধপাকা স্থাপনা তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। গত ছয়-সাত বছরে পূর্বে শাখাওয়াত হোসেনের বাড়ির চারপাশে বসতি গড়ে উঠে। ফলে বন্ধ হয়ে যায় বাড়িতে যাওয়া আসার পথ। এরপর থেকে ১০ ইঞ্চি সরু গলি দিয়ে চলাচল করছেন এসব পরিবারের লোকজন।
এক বছর পূর্বে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শাখাওয়াত হোসেন মারা যায়। মারা যাওয়ার পর লাশ বের করা নিয়ে বিপত্তি দেখা দেয়। পরে পাশের বাড়ির একটি দেয়াল ভেঙ্গে শাখাওয়াত হোসেনের লাশ বের করে দাফন করা হয়। এরপর থেকে রাস্তা বড় করার জন্য ছোটাছুটি শুরু করেন নিহত শাখাওয়াতের পরিবার। শাখাওয়াতের বাড়ির ডান পাশে জেলা কারাগারের সীমানা প্রাচীর। সামনে এন কে এম হাই স্কুল এন্ড হোমস স্কুলের অডিটরিয়াম। বাম পাশে কবির হোসেনর ৫ তলা বাড়ি। চার পাশে বিভিন্ন স্থাপনার কারণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে পরিবারটি।
১৫ দিন আগে শাখাওয়াত হোসেনের ছোট ভাই আহসান হাবিব (৩২) স্ট্রোক করেন। ওই সময় তাদের পরিবারের লোকজন আহসানকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেনি। পরে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় আহসান। কিন্তু লাশ বের করা নিয়ে পুনরায় বিপত্তি দেখা দেয়। নিরুপায় হয়ে এলাকার লোকজন দমকল বাহিনীকে খবর দেয়া হয়। লাশ বের করার কোন রকম উপায় না দেখে দমকল বাহিনীর সদস্য ও নিহতের পরিবারের সদস্যরা জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষের নিকট ছুটে যায়।
পরে মানবিক দিক বিবেচনা করে জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষ সীমানা প্রাচীরের উপর দিয়ে জেলাখানার প্রধান ফটক দিয়ে আহসানের লাশ বের করার অনুমতি দেয়া হয়। লাশ বের করার প্রক্রিয়ার স্থির চিত্র ধারণ করে ফেসবুকে পোস্ট করেন এলাকাবাসী। ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠে।লাশ উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া দমকল বাহিনির সদস্য নূরুল হক বলেন, বাড়িটিতে যাতায়াতের জন্য যে জায়গা আছে, তাতে একটি মানুষ স্বাভাবিকভাবে সোজা হয়ে যেতে পারবে না। তাই আমরা এই পথ দিয়ে লাশ বের করতে পারিনি। নিরুপায় হয়ে একটি বাড়ি ও জেলাখানার সীমানা প্রাচীররের উপর দিয়ে স্ট্রেচারে করে লাশ বের করে আনি।
জেলা সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, নিরাপত্তা জনিত কারণে জেলাখানার ভেতর দিয়ে যাওয়া আসার সুযোগ নেই। নিহতের স্বজন ও ফায়ার সার্ভিসের আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলার মুজিবর রহমান ও আমি বাড়িটি সরজমিনে পরিদর্শন করি। দাফনের জন্য লাশ বের করার কোন জায়গা না থাকায় মানবিক দিক চিন্তা করে অনুমতি দেয়া হয়।
স্থানীয় এন কে এম স্কুল হোমসের প্রধান শিক্ষক মো. শাজাহান বলেন, আমরা যখন অডিটরিয়ামের জায়গা ক্রয় করি তখন থেকেই বাড়িটির এই অবস্থা। অডিটরিয়ামের জায়গাটিতে জানুয়ারি মাসের দিকে স্থায়ী ভবনের কাজ শুরু হবে। মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদেরকে রাস্তার জায়গা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আমাদের চেয়ারম্যান।