ঈদযাত্রায় মহাসড়ক অচল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা
---
এবারের ঈদযাত্রা মসৃণ হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ছয়টি বড় মহাসড়কের মধ্যে চারটির অবস্থাই বেহাল। এসব রাস্তার বিভিন্ন অংশ ছোটবড় গর্তে ভরা। এছাড়া বন্যায় বিভিন্ন সড়ক বিধ্বস্ত হওয়ার ফলে তা আরও ভোগান্তি বাড়াতে পারে। এ অবস্থায় ঘরমুখী মানুষের ভীড় ও ঢাকমুখী কোরবানির পশুবাহী যানবাহনের যাতায়াত বেশ দুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারে। দুর্ভোগ আশঙ্কায় বাড়তি চাপ হিসেবে অব্যাহত বৃষ্টি পরিস্থিতিতো থাকছেই।
এ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মহাসড়কে কত কিলোমিটার ভাঙাচোরা সেটা বড় কথা নয়। এক কিলোমিটার খারাপ সড়কের জন্যও পুরো মহাসড়ক অচল হয়ে যেতে পারে। ২০১৫ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পুরোটাই চলনসই ছিল। কিন্তু সীতাকুণ্ডের এক কিলোমিটার এলাকায় ভাঙনের কারণে পুরো মহাসড়কে যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়ে। আর ঈদে সড়কে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। ঈদুল আজহায় পশুবাহী যানবাহন বেশি বিকল হয়, যা দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে সড়কের অবস্থা খুব খারাপ। এখনই রংপুর থেকে ঢাকায় বাস আসতে এক দিন লাগে। গাজীপুর থেকে মহাখালী বাস আসতে লেগে যায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। সিলেটে এখন ১০-১২ ঘণ্টা লাগছে। সব মিলিয়ে এবার ঈদে দুর্ভোগ হবে।
ঢাকা-উত্তরবঙ্গ, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-বরিশাল— এই চারটি পথের যাত্রায় ভয়ের মূল কারণ বিভিন্ন অংশে খানাখন্দ। এর সঙ্গে সড়কে নির্মাণ আর সম্প্রসারণের কাজ যুক্ত হয়ে যানবাহনের গতি কমে তৈরি হচ্ছে যানজট।
এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দুটির চার লেনের কাজ শেষ হয়েছে গত বছর। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রীদের মূল দুর্ভোগ ঢাকার যাত্রাবাড়ী-কুতুবখালী অংশের হাঁটুসমান গর্ত এবং মেঘনা-গোমতী সেতুর জট। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী অংশ বেহাল। ময়মনসিংহের পর জামালপুর ও নেত্রকোনার পথের মহাসড়কের অবস্থাও ভালো নয়।
৯ আগস্ট সিরাজগঞ্জে বেহাল সড়ক পরিদর্শন করতে গিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মহাসড়ক চলাচলের উপযোগী করতে ১০ দিন সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। এরপর দেশের সড়ক-মহাসড়কে খোয়া-বালু এবং কোথাও কোথাও পিচ ঢালাইয়ের মেরামত চোখে পড়েছে। কিন্তু এগুলো টিকছে না। এর আগে ঈদুল ফিতরের আগে-পরে সড়কে বিপুল মেরামতকাজ দেখা যায়। সেটাও বিফলে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সারা দেশে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অধীন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়ক আছে ২১ হাজার ১২৩ কিলোমিটার। সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ (এইচডিএম) প্রতিবছর সংস্থাটির অধীন সড়কের অবস্থা জরিপ করে। এবার এখনো জরিপের ফল প্রকাশিত হয়নি। এইচডিএম সার্কেলের গতবারের হিসাব বলছে, মোট সড়কের ৩৯ শতাংশ ভালো। আর প্রায় ২৪ শতাংশ চলনসই। বাকি ৩৭ শতাংশ খারাপ ও খুব খারাপের পর্যায়ে। অন্যদিকে ৩ হাজার ৭৯০ কিলোমিটার মহাসড়কের ৫৪ শতাংশ ভালো। প্রায় ২৬ শতাংশ সড়ক চলনসই। বাকি ২০ শতাংশ মহাসড়ক খারাপ ও খুব খারাপের পর্যায়ে।
তবে সওজের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এবারের অতিবৃষ্টি ও বন্যার পর চলনসই ২৬ শতাংশ মহাসড়ক আর চলনসই নেই। তা এখন অর্ধেকই খারাপের পর্যায়ে চলে গেছে। কারণ, টুকটাক যেসব মেরামত করা হচ্ছে, তা টিকছে না। খারাপ আর খুব খারাপ সড়ক এখন কী হয়েছে, তা তো অনুমানই করা যায়। অর্থাৎ মহাসড়কের অর্ধেকই বলা চলে এখন ভাঙাচোরা। আর আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়কের অনেকগুলোই এখন পানির নিচে।
অনুসন্ধানে এসেছে, দেশের ১৪টি জেলায় প্রায় ৫৩৭ কিলোমিটার মহাসড়কের অবস্থা ভালো নয়। কোথাও কোথাও গর্ত এতটাই বড় যে যানবাহন চলতে গিয়ে এপাশ-ওপাশ কাত হয়ে পড়ছে। মালবাহী ভারী যান বিকল হয়ে যানজটের সৃষ্টি করছে। এই জেলাগুলো হচ্ছে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, যশোর, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, খুলনা, বরিশাল, নরসিংদী, সিলেট ও নেত্রকোনা।
এর বাইরে সওজ এবার বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে দেখা যায়, বন্যার কারণে দেশের ১৭টি আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক পানিতে নিমজ্জিত ছিল। ৭৩টি জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে প্রায় তিন কিলোমিটার পানির তোড়ে ভেসে গেছে। কোথাও কোথাও ২ থেকে ২৫ ফুট পর্যন্ত সড়কে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। দিনাজপুর ও কুড়িগ্রাম জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, এবার অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে সমস্যা বেশি হয়েছে। এখন প্রকৃতিকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। তাই মানুষ আগে থেকে বাড়ি যাওয়া শুরু করলে সমস্যা কম হতো। এখন সড়ক ও ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থাপনার ওপর ভরসা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ‘গত ঈদুল ফিতরের আগে-পরে প্রচুর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয়েছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে তা নষ্ট হওয়ার কথা নয়। নিশ্চয়ই কোথাও কোনো গলদ আছে। এই প্রশ্নের উত্তর দরকার আছে। নতুবা এটা শুধু দুর্ভোগের বিষয় নয়। আর বৃষ্টি তো অন্য দেশেও হয়। তারা কীভাবে ব্যবস্থাপনা করে, এটা কি আমরা শিখছি? এসব প্রশ্নের উত্তর না পেলে দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’
সওজ সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে দৈনন্দিন সড়ক মেরামতের জন্য ১ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। গত বছর খরচ করা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এভাবে প্রতিবছরই বরাদ্দ বাড়ছে। এর বাইরে বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে নির্মাণ ও মেরামতে ৮৭টি প্রকল্প চলমান আছে। এগুলোর ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক বলেন, বৃষ্টির কারণে সারা দেশেই মহাসড়কের ওপরের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ভিত্তি ঠিক আছে। তিন-চার দিন একটানা রোদ পেলে ঠিক করা যাবে। আর বন্যায় যেসব সড়ক তলিয়ে গেছে, সেগুলোও মেরামত চলছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ঈদুল ফিতরের মতো যাত্রা মসৃণ হবে না।
গত ঈদে মেরামত করা সড়ক কেন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, পানি হচ্ছে বিটুমিনের শত্রু। বৃষ্টি হলে সড়ক ভালো রাখার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। বৃষ্টিতে সড়ক ভাঙবেই। তাঁরা স্বাভাবিক চলাচল ঠিক রাখার চেষ্টা করছেন।
প্রথম আলো থেকে