ভাগ্য ও নিয়তির মাঝে পার্থক্য কী?
ভাগ্য (قضاء) ও নিয়তি (قدر) এর মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষেত্রে আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো আলেম, قضاء কে قدر হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। আর কেউ কেউ বলেছেন, قضاء ও قدر দুটো আলাদা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এ দুটো মতের একটি মতকে প্রাধান্য দিয়েছে এমন কোন অভিমত রয়েছে কি? যদি কেউ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন তাহলে এ প্রাধান্য দেয়ার দলিল কী? কোনটি আগে? قضاء নাকি قدر?
ইসলাম কিউ.কমে এ প্রশ্নটি করা হয়। এ প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়,
কিছু কিছু আলেমের মতে, قضاء (ভাগ্য) ও قدر (নিয়তি) একটি অপরটির সমার্থবোধক শব্দ।
কিছু কিছু ভাষাবিদের অভিমতও এ রকম; যারা قضاء কে قدر দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন।
ফিরোজাবাদী রচিত ‘আল-ক্বামুসুল মুহীত’ (৫৯১ পৃষ্ঠা) এ এসেছে-
القدر: القضاء والحكم
(অর্থ- ক্বদর হচ্ছে: ক্বাযা ও হুকুম।)
শাইখ বিন বায (রহ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: ক্বাযা ও ক্বদরের মধ্যে পার্থক্য কি?
জবাবে তিনি বলেন: قضاء ও قدر একই জিনিস। অর্থাৎ আল্লাহ্ পূর্বেই যে সিদ্ধান্ত করে রেখেছেন ও পূর্বেই যা নির্ধারণ করে রেখেছেন; এটাকে বলা হয় ক্বাযা, আবার একেই বলা হয় ক্বদর।
অপর একদল আলেম এ দুটোর মাঝে পার্থক্য করেছেন।
তাদের কারো কারো মতে, قضاء (ক্বাযা) قدر (ক্বদর) এর আগে।
ক্বাযা: অনাদিকাল থেকে আল্লাহ্র জ্ঞান ও সিদ্ধান্তে যা রয়েছে।
আর ক্বদর: এ জ্ঞান ও সিদ্ধান্তের আলোকে সৃষ্টির অস্তিত্ব হওয়া।
হাফেয ইবনে হাজার (রহঃ) ফাতহুল বারী গ্রন্থে (১১/৪৭৭) বলেন: “আলেমগণ বলেন, ক্বাযা হচ্ছে- অনাদিকাল থেকে সামগ্রিক ও সামষ্টিক সিদ্ধান্ত। আর ক্বদর হচ্ছে, সে সিদ্ধান্তের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশসমূহ।”
তিনি ফাতহুল বারীর অন্য এক স্থানে (১১/১৪৯) বলেন: “ক্বাযা হচ্ছে, অনাদিকাল থেকে সমষ্টিগত সামগ্রিক সিদ্ধান্ত। আর ক্বদর হচ্ছে- সে সামষ্টিক সিদ্ধান্তের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ও আলাদা আলাদা সিদ্ধান্তসমূহ।”
আল-জুরজানী তাঁর ‘আল-তা’রীফাত’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা- ১৭৪) বলেন,
“ক্বদর হচ্ছে- ক্বাযা মোতাবেক সম্ভাব্য বিষয়গুলো একের পর এক অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আসা। ক্বাযা অনাদিকালের সাথে সম্পৃক্ত। আর ক্বদর ঘটমান।
ক্বাযা ও ক্বদর এর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে: ক্বাযা হচ্ছে- লাওহে মাহফুযে সকল অস্তিত্বশীলের সমষ্টিগত অস্তিত্ব হওয়া। আর ক্বদর হচ্ছে, নির্দিষ্ট বস্তুগুলোর কারণ সংঘটিত হওয়ার পর পৃথক পৃথকভাবে সেগুলো অস্তিত্বে আসা।”
আলেমদের বিপরীত একটি অভিমতও রয়েছে। এ মতাবলম্বীদের দৃষ্টিতে, ক্বদর হচ্ছে ক্বাযা এর পূর্বে। অর্থাৎ অনাদিকালের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ক্বদর। আর কোন কিছুকে সৃষ্টি করা হচ্ছে, ক্বাযা।
আল-রাগেব আল-ইসফাহানি ‘আল-মুফরাদাত’ গ্রন্থে বলেন: “আল্লাহ্র কর্তৃক নির্ধারিত ক্বাযা ক্বদর এর চেয়ে খাস। কেননা ক্বাযা হচ্ছে তাকদীরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তাই ক্বদর হচ্ছে- তাকদির (নির্ধারণ)। আর ক্বাযা হচ্ছে চূড়ান্ত ও অকাট্য।
আলেমদের কেউ কেউ বলেন, ক্বদর হচ্ছে, পরিমাপ করার প্রস্তুতির পর্যায়ে। আর ক্বাযা হচ্ছে, পরিমাপের পর্যায়ে। এর সপক্ষে দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: ( وَكَانَ أَمْرًا مَقْضِيًّا ) (অর্থ, “এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার”) ( كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا ) (অর্থ, “এটা আপনার রবের অনিবার্য সিদ্ধান্ত”) ( وَقُضِيَ الأَمْرُ) (অর্থ, “এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হল”)। এ স্থানগুলোতে ক্বাযা শব্দটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এ কথা বুঝানোর জন্য যে এ সিদ্ধান্ত আর অপনোদন হওয়া সম্ভবপর নয়।”
আলেমদের মধ্যে কারো কারো মতে, এ শব্দদ্বয় আলাদা আলাদা স্থানে উদ্ধৃত হলে একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর একই স্থানে ব্যবহৃত হলে প্রত্যেকটির ভিন্ন ভিন্ন অর্থ থাকে।
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) এর মতে,
ক্বদর এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, নির্ধারণ করা। আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “নিশ্চয় আমরা প্রত্যেক কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।” [সূরা ক্বামার, আয়াত: ৪৯] আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন, “অতঃপর আমরা পরিমাপ করেছি, সুতরাং আমরা কত নিপুণ পরিমাপকারী।” [সূরা মুরসালাত, আয়াত: ২৩] পক্ষান্তরে, ক্বাযা শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, রায়, ফয়সালা।
তাই আমরা বলব, ক্বাযা ও ক্বদর যদি একই স্থানে আসে তাহলে এ দুটি ভিন্নার্থবোধক। আর যদি আলাদা আলাদা স্থানে আসে তাহলে এ দুইটি সমার্থবোধক। যেমনটি আলেমগণ বলে থাকেন, هما كلمتان: إن اجتمعتا افترقتا، وإن افترقتا اجتمعتا. (অর্থ, এ দুটি এমন শব্দ একত্রিত হলে ভিন্নার্থবোধক; আর পৃথকভাবে এলে সমার্থবোধক)
যদি কেউ বলে, আল্লাহ্র ক্বদর ক্বাযাকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর যদি দুটোকে একত্রে উল্লেখ করা হয় তাহলে প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা অর্থ রয়েছে।
ক্বদর (তাকদীর) হচ্ছে, অনাদিকালে আল্লাহ্ সৃষ্টির ব্যাপারে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন।
ক্বাযা হচ্ছে, সৃষ্টির অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব ও পরিবর্তন ইত্যাদির ক্ষেত্রে আল্লাহ্র সিদ্ধান্ত। এর ভিত্তিতে ক্বদর বা তাকদির আগে।
যদি কেউ বলেন যে, যখন শব্দদ্বয় এক জায়গায় আসবে এবং আমরা বলব, ক্বাযা হচ্ছে, সৃষ্টির অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব ও পরিবর্তন ইত্যাদির ক্ষেত্রে আল্লাহ্র সিদ্ধান্ত এবং ক্বদর হচ্ছে- ক্বাযার আগে; তাহলে এ দৃষ্টিভঙ্গি আল্লাহ্র নিম্নোক্ত বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক “তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তা নির্ধারণ করেছেন যথাযথ অনুপাতে।” [সূরা ফ্বুরকান, আয়াত: ২] কেননা এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে, তাকদীর (ভাগ্য নির্ধারণ) সৃষ্টির পর?
এর উত্তর দুইভাবে দেয়া যেতে পারে, আমরা বলব, আয়াতের এ ক্রমধারা উল্লেখের ক্রমধারা, উদ্দিষ্টমূলক নয়। আয়াতে সৃষ্টিকে তাকদিরের আগে উল্লেখ করা হয়েছে যাতে করে আয়াতের অন্তমিল ঠিক থাকে। আপনি তো জানেন যে, মুসা (আঃ) হারুন (আঃ) এর চেয়ে উত্তম। কিন্তু, সূরা ত্বহার এ আয়াতে হারুন (আঃ) কে মূসা (আঃ) এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে فَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سُجَّدًا قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ هَارُونَ وَمُوسَى) (অর্থ- “অতঃপর জাদুকরেরা সিজ্দাবনত হল, তারা বলল, আমরা হারূন ও মূসার রব- এর প্রতি ঈমান আনলাম।”[সূরা ত্বাহা, আয়াত: ৭০] যাতে করে আয়াতের অন্তমিল ঠিক থাকে।
এতে এ প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কাউকে পরে উল্লেখ করা তার মর্যাদা নিম্ন হওয়ার প্রমাণ বহন করে না।
কিংবা আমরা বলব যে, এখানে تقدير শব্দের অর্থ تسوية (সুষম গঠন করা)। অর্থাৎ আল্লাহ্ নির্দিষ্ট গঠনে তাকে সৃষ্টি করেছেন। যেমনটি আল্লাহ্ অন্য আয়াতে বলেছেন: “যিনি সৃষ্টি করেছেন অতঃপর সুষম করেছেন।”[সূরা আ’লা, আয়াত: ২] তাই تقدير এখানে تسوية অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
এ শেষোক্ত অর্থটি প্রথমটির চেয়ে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা এ অর্থটি আল্লাহ্র এ বাণীটির সাথে পুরোপুরি মিলে যায়, “যিনি সৃষ্টি করেছেন অতঃপর সুষম করেছেন।” এভাবে কোন আপত্তি থাকে না। [শারহুল আকিদা আল-ওয়াসিতিয়্যা (২/১৮৯) থেকে]
এ মাসয়ালার বিষয়টি খুবই সহজ। এ মাসয়ালার পেছনে পড়ে থাকায় বেশি কোন ফায়দা নেই। যেহেতু কোন আমল বা বিশ্বাসের সাথে এটি সম্পৃক্ত নয়। সর্বোচ্চ এতে যা আছে সেটা হচ্ছে সংজ্ঞাগত বিষয়। এ ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর এমন কোন দলিল নেই যে, যার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া যাবে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ঈমানের এই মহান রুকনের উপর ঈমান আনা ও বিশ্বাস স্থাপন করা।
খাত্তাবি (রহঃ) ‘মাআলিমুল সুনান’ গ্রন্থে (২/৩২৩) ক্বদর মানে তাকদির (পূর্ব নির্ধারণ), ক্বাযা মানে ‘সৃষ্টি করা’ এ কথা উল্লেখ করার পর বলেন: এ অধ্যায়ের (ক্বাযা ও ক্বাদরের) মোদ্দাকথা হল, এ দুইটি এমন বিষয় যে, একটি অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়। কেননা, এ দুইটির একটি ভিতের ন্যায়, অপরটি ভবনের ন্যায়। যে ব্যক্তি এ দুটোকে আলাদা করতে চায় সে যেন ভবনটাকেই ধ্বংস করতে চায়।”
শাইখ আব্দুল আযিয আলে শাইখকে জিজ্ঞেস করা হয়: ক্বাযা ও ক্বদর এর মধ্যে পার্থক্য কি?
জবাবে তিনি বলেন: আলেমগণের মধ্যে কেউ কেউ এ দুটোকে একই অর্থে গ্রহণ করেন। বলেন: যেটা ক্বাযা সেটাই ক্বদর। যেটা ক্বদর সেটাই ক্বাযা। আর কেউ কেউ এ দুটোর মাঝে এভাবে পার্থক্য করেন যে, ক্বদর হচ্ছে আম (সাধারণ); ক্বাযা হচ্ছে খাস (বিশেষ)। ক্বদর হচ্ছে ব্যাপক; আর ক্বাযা হচ্ছে ক্বাদরের অংশবিশেষ।
এ দুটোর প্রতি ঈমান আনা ফরয। আল্লাহ্ যা তাকদীরে নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং যা ক্বাযা বা সিদ্ধান্ত করে রেখেছেন উভয়টির প্রতি ঈমান আনা ও বিশ্বাস স্থাপন করা ফরয।
শাইখ আব্দুর রহমান আল-মামদুহ বলেন: “এ মতভেদের কোন ফলাফল নেই। কারণ আলেমগণের এই মর্মে ঐক্যমত রয়েছে যে, এ শব্দদ্বয়ের একটি অপরটির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং একটির পরিচয়ে অপরটির সংজ্ঞা উল্লেখ করতে কোন অসুবিধা নেই”।[আল-ক্বাযা ও ক্বদর ফি যাওয়িল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা-৪৪ থেকে সমাপ্ত] আল্লাহই ভাল জানেন।