ঝিনাইদহ প্রতিনিধি : ঝিনাইদহের শৈলকুপায় মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার আহমেদ মৃধার ওপর হামলাকারী ওরা কারা? সিসি টিভির ফুটেজ দেখে কয়েকজনের পরিচয় শনাক্ত করেছেন মুক্তার আহমেদ মৃধার ছেলে সুমন মৃধা। যাদের বেশির ভাগই স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল হাইয়ের অনুসারী।
মুক্তার আহমেদ মৃধা প্রসঙ্গে সহ সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের শৈলকুপা থানার সাবেক কমান্ডার মো. রহমাত আলী মন্টু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুক্তার আহমেদ মৃধা আট নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মঞ্জুরের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আমরা এক সঙ্গে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম।’
কয়েকজন হামলাকারীর পরিচয়
মামলার বাদী সুমন মৃধা জানান, ‘হামলাকারীরা সবাই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী। যে হাতুড়ি দিয়ে আমার পিতার ওপর আক্রমণ চালায় তার নাম ‘রিপন’। সে সোনা শিকদারের লোক। বাড়ি খালকোলা এলাকায়। লুঙ্গি পরা ব্যক্তির নাম ‘জাবেদ’। তার বাড়ি হরিহরা গ্রামে। লাল গেঞ্জি পরা ব্যক্তির নাম ‘সুমন’। তার বাড়িও হরিহরা গ্রামে। এছাড়া সাদা চেক গেঞ্জি পরা লোকটির নাম ‘শাওন’।’ তিনি উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।
কেন এ হামলা?
জানা গেছে, সম্প্রতি শৈলকুপা উপজেলার রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজে ছয় কোটি টাকার চারটি দরপত্র আহ্বান করে এলজিইডি। মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার আহমেদ ১৭ অক্টোবর অনলাইনে দরপত্র জমা দেন। যাচাইবাছাই শেষে ১৮ অক্টোবর বিভিন্ন শর্ত পূরণ করায় ও সর্বনিম্ন দরপত্র হওয়ায় তিনি ছয় কোটি টাকার কাজ পেয়ে যান। কাজটি না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে সংসদ সদস্য আব্দুল হাইয়ের ক্যাডাররা। তারা ক্ষুব্ধ হয়ে মোক্তার হোসেন মৃধাকে মুঠোফোনে মারধর ও হত্যার হুমকি দেয়। পরে গত ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটের দিকে তার ওপর হামলা করে স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল হাইয়ের অনুসারীরা। বাবাকে বাঁচাতে গেলে তার ছেলে গোলাম মুর্শিদকেও পিটিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়া হয়।
মুক্তার আহমেদ মৃধা সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় ওষুধের দোকানে বসে ছিলাম। ওই এলাকাটি পুরো সিসি ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণাধীন। হঠাৎ ওরা আমার ওপর হামলা চালায়। বলতে শুরু করে ‘ওই শালা তুই টেন্ডার জমা দিছস ক্যান?’ আমাকে যখন মারতে শুরু করে তখন কেউ ফিরাতে আসেনি। ছেলে ঠেকাতে এলে তাকেও মেরে রক্তাক্ত করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার অপরাধ টেন্ডারে অংশ নিয়ে কাজটি পেয়ে যাওয়া। কয়েকবার হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। আমি বলেছি, আমি কাজ পেয়েছি, আমি করবই। কিন্তু আজ আমাকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালের বিছানায় ঘুরতে হচ্ছে।’
মুক্তার আহমেদ মৃধা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ই-টেন্ডার চালু করেছেন। টেন্ডারে কে অংশ নিল, সর্বনিম্ন দরদাতা কে হবেন, তা কারও জানা থাকে না। কিন্তু তারা কিভাবে জানলো?’
সংসদ সদস্য আবদুল হাইয়ের বক্তব্য:
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল হাই বলেন,‘ আমি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাই এ জেলার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের সবাই আমার অনুসারী। তবে ওই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল বলে জানতে পেরেছি তাদের মধ্যে তিনজন হচ্ছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের পদধারী। তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ভাবে এসব সংগঠনের কমিটি ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা তাদের বলেছি ঘটনা তদন্ত করে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নিতে। তারা তাই করেছে। মুক্তিযোদ্ধার ওপরে হামলার ঘটনায় আমরা নিন্দা জানিয়েছি। এছাড়াও প্রশাসনকেও বলেছি কেউ দোষী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। যদি তারা আমাদের দলেরও হয় তাহলেও প্রশাসন ব্যবস্থা নিক আমি আপত্তি করবো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ সংসদীয় কমিটির বৈঠকে অংশ নিতে আমি ১৫ অক্টোবর ঢাকায় চলে আসি। দলের সম্মেলন শেষে আমি এলাকায় ফিরেছি ২৫ অক্টোবর। তাই ওই ঘটনার সময় আমি এলাকায় ছিলাম না। আর আমি থাকি ঝিনাইদহ সদরে, ঘটনা ঘটেছে শৈলকুপায়। তাই ওখানে কী ঘটেছে তা আমি আগে থেকে জানতাম না। ঘটনা ঘটনার পরে তা জেনেছি।
তিনি আরও বলেন,‘ আমি ৫৩ বছর ধরে রাজনীতি করছি। এই সুদীর্ঘ সময়ে কাউকে আমি একটা থাপ্পড় মেরেছি এটা কেউ প্রমাণ করতে পারলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেবো।’
এ ঘটনার পেছনে কারা জড়িত জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করছে এটা তাদের কাজ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি গত সংসদ নির্বাচনে তার বিপক্ষে ফুটবল মার্কা নিয়ে স্বতন্ত্র পদে নির্বাচনকারী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নায়েব আলী জোয়ার্দার ও তার অনুসারীদের ইঙ্গিত করে বলেন, তারাই তার সুনাম ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে। এ ঘটনায় তারা জড়িত থাকতে পারে।’
মুক্তার আহমেদ মৃধার পরিচয়
মুক্তার আহমেদ মৃধা ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও শৈলকুপা উপজেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক। কেবল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেই যুক্ত নন তিনি। এলাকায় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি হিসেবেও বেশ পরিচিত। তার হাত ধরে গড়ে ওঠেছে যমুনা শিকাদার কলেজ। প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি পদ ছাড়াও তিনি রয়েছেন আরও তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একই পদে। এছাড়া তিনি উপজেলার আবাইপুর ইউনিয়নের দুই দুইবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্য
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শৈলকুপা থানার এসআই ইকবাল হোসেন জানান, ‘মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তার আহমেদ মৃধার ওপর হামলার ঘটনায় তার ছেলে সুমন মৃধা বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলায ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি আশরাফুলকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। বাকিরা আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। তবে মামলার তদন্তের স্বার্থে তিনি এজাহারভুক্ত অন্য ৯ আসামির নাম ও পরিচয় দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাবেক মৎস ও প্রাণী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং শৈলকুপা-১ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বাংলা ট্রিবিউন