‘আমার ভাই, আমায় ফিরিয়ে দাও’
মাঝখানে দু’টো কোল্যাপসিবল গেটের আড়াল। তিন বছর পর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুই ভাই। চোখ ফেটে জল আসে ৩৪ বছরের রোগাটে যুবকের। রপ্ত করা হিন্দি ভুলে মাতৃভাষা বলে ফেলেন রোহিঙ্গা যুবক মুহম্মদ এরশাদ। ‘আঁরো বাই, আঁরে দি ফেলো।’ (আমার ভাই, আমায় ফিরিয়ে দাও।)মা, বাবা, ছ’ভাই, দু’বোন বছরখানেক ধরে বাংলাদেশের কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে। ২০১৭ সালে ২৫ অক্টোবরের পর মিয়ানমারে সেনা নিপীড়নের মুখে সইতে না পেরে রোহিঙ্গা পরিবারটি বাংলাদশে পালিয়ে আসে। গত ৮ মাস আগে ভারতে এসেছেন সবার বড় ভাই এরশাদ। তারপর দিল্লি থেকে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু পরিচয়পত্র জোগাড় করার লড়াই শুরু করেন নামমাত্র শিক্ষিত এ যুবক। ছোট ভাই ১৭ বছরের মুহম্মদ জুবের যে কলকাতার হাওড়া এলাকার একটি হোমে বন্দি।
দিল্লির মেরঠে মোবাইল টাওয়ার বসানোর দিনমজুরিতে পেট চলছে এরশাদের। ভাইকে উদ্ধারে মাসে-মাসে আসতে হয় কলকাতায়। হাওড়া ময়দানের মসজিদ-চত্বরে রাতভর পড়ে থাকেন এরশাদ! ছোটাছুটি চলে বাগনানের হোম, কলকাতা, হাওড়ার সমাজকল্যাণ দফতর, উকিলের চেম্বার বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে!বাগনানের হোম কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র দফতরের নির্দেশ দেখান— রোহিঙ্গাদের ছাড়া যাবে না, তাদের মায়ানমারে ফেরাবে দিল্লি। এর বিরুদ্ধেই মামলা গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। অন্যতম আবেদনকারী পশ্চিমবঙ্গের শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন। চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তীর কথায়, ‘জাতিসংঘের শর্ত অনুযায়ী, কোনও শিশুকে বিপদের মুখে ফেলা যায় না। জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট অনুযায়ীও, উদ্বাস্তু এই শিশুদের সুরক্ষায় সরকার দায়বদ্ধ।’
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেই বিভিন্ন হোমে ২৯ জন রোহিঙ্গা শিশু আটক। দমদম জেলেও আছে আরও ১৭টি শিশু, মায়ের সঙ্গে। হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদহের হোমেও রয়েছে আরো কিছু রোহিঙ্গা শিশু যাদের দেশ বা পরিবার বলতে কিছুই নেই। আইনজ্ঞদের মতে, শিশু অধিকার রক্ষা আইনে, এই নাবালকদের পরিবারের কাছে তুলে দেওয়ায় বাধা নেই। উদ্বিগ্ন স্বরাষ্ট্র সচিব অত্রি ভট্টাচার্য বলছেন, ‘দেখছি কী করা যায়।’ এরশাদের সমস্যাটি তিনি শুনেছেন।
ভাইকে নিয়ে এরশাদ অবশ্য মায়ানমারে ফেরার কথা ভাবতেই পারেন না। রাখাইন প্রদেশের মংডু উপনগরীর কাছে বাদৌলা গ্রামে বাড়ি, জমিজমা ছিল তাদের। জন্মভূমিতেও পুলিশের হুমকি নিত্যসঙ্গী বরাবরই। তিন বছর আগে জুবের মামাবাড়ি গিয়েছিল। তখনই পুলিশ পরিবারের সবার নাম নথিভুক্ত করতে আসে। জুবের বাড়ি না-থাকায়, তার অস্তিত্ব অস্বীকার করে পুলিশ। ভয় পেয়ে জুবেরকে ভারতের হায়দরাবাদে কয়েকজন পরিচিত রোহিঙ্গার আশ্রয়ে পাঠায় পরিবার। বছর দুয়েক আগে বাড়ির জন্য মন কেমন করায় পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ হয়ে ফেরার কথা ভাবে সে। এরপরই হাওড়ায় রেলপুলিশের হাতে ধরা পড়ে। ঠাঁই হয় কলকাতার এই হোমে। পরে তার কথা জানতে পারে জুবেরের পরিবার।
হোমে চটের কাজ, চুল কাটায় হাত পাকিয়েছে জুবের। ফিরতে চায় পরিবারের কাছে। এরশাদ বলেন, ‘মা-বাবা আমার পথ চেয়ে। আর এ হোমে গেটের ওপারে ভাইটার সামনে দাঁড়ালে পাগল-পাগল লাগে!’জন্মভূমি মিয়ানমারে রয়েছে সংখ্যাগুরু বার্মিজ ও সেনাদের অত্যাচার। আর ভারতে এখন ভাইয়ের জন্য দরজায় দরজায় ধর্না দিয়ে বেরাচ্ছেন এরশাদ। সবমিলিয়ে মানুষের মতো বেঁচে থাকার কথাটাই যেন ভুলে গেছেন দেশহীন এই যুবক।সূত্র: আনন্দবাজার