আল্লাহর প্রতি সমর্থিত হওয়ার শিক্ষাই কোরবানি
মুসলমানরা বছরে দুটি ঈদ পালন করে থাকেন। একটি ঈদুল ফিতর ও অন্যটি ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহা অর্থ কোরবানির ঈদ। আরবি দ্বাদশ মাস জিলহজের ১০ তারিখে এই দিবসটি উদযাপিত হয়। এদিন আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের পর সুনির্দিষ্ট পশু কোরবানি বা উত্সর্গ করা হয় বলে এই উত্সবকে বলা হয় ঈদুল আজহা। এ সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) বলেন, ‘উমিরতু বিইয়াওমিল আজহা জায়া’লাল্লাহু ঈদান লি হাজিহিল উম্মাহ।’ অর্থাত্, আমি আজহা বা কোরবানির দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ তা এই উম্মতের জন্য ঈদ বা আনন্দের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন (আবুদাউদ, নাসাঈ, আহমদ)।
উল্লেখ্য, ঈদের দিনেই অধিকাংশ মুসলমান পশু কোরবানি করে থাকেন। তবে কোনো কারণে না দিতে পারলে পরবর্তী দুদিনের মধ্যেও কোরবানি দেওয়া যায়। মূলত মহান সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে পশু উত্সর্গ করার প্রচলন মানব জাতির আদিকাল থেকেই চলে আসছে। বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম কোরবানির ঘটনা ঘটে আদিপিতা হযরত আদম (আ)-এর সময়। আদিমাতা হযরত হাওয়া (আ)-এর গর্ভে প্রতিবছর একপুত্র ও এককন্যা জন্মগ্রহণ করতেন। তখন যেহেতু মানব জাতির বিস্তার ঘটেনি, তাই এক যমজ পুত্রের সাথে অন্য যমজ কন্যার বিয়ে দেওয়ার রীতি-নীতি ছিল। সেই অনুযায়ী বড় ভাই হাবিলের সাথে ছোট ভাই কাবিলের যমজ বোন আকলিমার বিয়ে দেওয়াই নিয়ম। কিন্তু কাবিল নিজ যমজ বোনকে বিয়ের ব্যাপারে জেদ ধরলে দুই পুত্রকে কোরবানি দিতে বলা হয় এবং যার কোরবানি আল্লাহ কবুল করবেন, সিদ্ধান্ত হয় তার সাথে হবে আকলিমার বিয়ে। এই উদ্দেশ্যে হাবিল পাহাড়ের উপর একটি দুম্বা রাখলেন। আর কাবিল রাখলেন কিছু শস্য। তারপর আকাশ থেকে বজ্রপাত পড়ল এবং হাবিলের রেখে আসা দুম্বা ভস্মীভূত হলো। এই অলৌকিক কোরবানি থেকে বোঝা গেল আল্লাহ হাবিলের কোরবানি কবুল করেছেন। কাবিল তখন রাগান্বিত হয়ে নিজ ভাইকে পাথর মেরে হত্যা করল। বলাবাহুল্য, এটাই মানব ইতিহাসে প্রথম হত্যার ঘটনা।
তবে মুসলমানরা হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর একটি অবিস্মরণীয় ঘটনাকে স্মরণ ও অনুসরণ করে প্রতিবছর কোরবানি দিয়ে থাকেন। হযরত ইব্রাহিম (আ)-কে বলা হয় মিল্লাতে আবা ইব্রাহিম বা মুসলিম জাতির পিতা। তাঁর বংশধরদের মধ্য থেকে অসংখ্য নবী-রাসুলের আগমন ঘটেছে। বর্তমান বিশ্বের তিনটি প্রভাবশালী ধর্ম—ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলামের প্রবর্তকগণ তাঁরই বংশধর। এই কারণে এই তিন ধর্মের অনুসারীরাই তাঁকে সম্মান করেন। একদিন তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে তার প্রিয়বস্তু কোরবানি করতে বলছেন। নবীর স্বপ্ন অহির সমতুল্য বিধায় তিনি পরদিন কিছু উট কোরবানি করলেন। দ্বিতীয় রাতেও তিনি একই স্বপ্ন দেখলেন। তখন দুশো উট কোরবানি করলেন। তৃতীয় রাতেও তিনি দেখলেন একই স্বপ্ন। এবার তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তার নিকট তো সবচেয়ে প্রিয়বস্তু তাঁর প্রাণাধিক সন্তান। ৮৬ বছর বয়সে মা হাজেরা (আ)-এর গর্ভে জন্ম নেন হযরত ইসমাইল (আ)। তখন তার বয়স মাত্র ১৩-১৪ বছর। একমাত্র সন্তান বলে তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের সবে ধন নীলমণি। কিন্তু আলিমুল গায়েব মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ তো উপেক্ষা করা যায় না। তাই তিনি মক্কার নিকটবর্তী মিনায় গিয়ে নিজপুত্রকে কোরবানি করতে উদ্যত হলেন। আল্লাহর নির্দেশ জেনে নবীপুত্র ইসমাইলও আনন্দিত চিত্তে নিজেকে উত্সর্গ করতে রাজি হলেন। কোরবানির পর দেখা গেল ইসমাইলের জায়গায় একটা দুম্বা জবাই হয়ে পড়ে আছে। আর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন ইসমাইল (আ)। পবিত্র কোরআনের সূরা আস-সাফাতের ১০২-১১২নং আয়াতে এই কাহিনির বিবরণ রয়েছে।
কোরবানির শব্দমূল কুর্ব, যার অর্থ নৈকট্য। আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই দেওয়া হয় কোরবানি। কোরআন শরীফে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর নিকট পৌঁছে না কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া’ (সূরা হজ, আয়াত-৩৭)। এখানে তাকওয়া অর্থ খোদাভীতি। অর্থাত্ জীবন চলার পথে কে কত আল্লাহকে ভয় করে চলেন, তাঁর বিধি-নিষেধ মেনে চলেন, তারই নাম তাকওয়া। এক আল্লাহর প্রতি পুরোপুরি সমর্পিত হওয়ার নাম ইসলাম। আর কোরবানির মাধ্যমে এই সমর্পণের সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। কোরবানির জন্য যে পশু নির্বাচন করা হয়, তা হতে হয় নিজের পছন্দনীয় ও নিখুঁত। এরপর এই পশুর প্রতি যাতে মায়া তৈরি হয় এজন্য কিছুদিন বেঁধে রেখে লালন-পালন করা ভালো। তারপর কোরবানির সময় যে আয়াতটি পড়তে হয় তার অর্থ হলো—‘নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য।’ এভাবে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠভাবে সমর্পিত হওয়া শিক্ষাই দেয় কোরবানি।
এদিকে আল্লাহ তায়ালা সূরা হজের ৩৪ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘ওয়া লিকুল্লি উম্মাতিন জায়া’লনা মানসাকাল লিইয়াজকুরুসমাল্লাহি ‘আলা মা রাজাকাহুম মিন বাহিমাতিল আনয়া’ম…।’ অর্থ :আমি প্রত্যেক জাতির জন্য পশু কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে করে লোকেরা যা তিনি তাদেরকে দিয়েছেন সেসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে। এ থেকে বোঝা যায়, সকল সম্প্রদায়ের মাঝে ও ধর্মে কোরবানি অন্যকথায় পশু উত্সর্গের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। হয়তো ধরন ও পদ্ধতিগত পার্থক্য আছে। যেমন—মুসলমানগণ কোরবানি করে তিনভাগ মাংসের এক ভাগ ফকির-মিসকিন ও একভাগ আত্মীয়-স্বজনের মাঝে বিতরণ করেন এবং বাকি এক ভাগ নিজেরা খেয়ে থাকেন। ইহুদিগণ কোরবানি করে তিনভাগ মাংসের একভাগ সিনাগগ বা উপাসনালয় উদ্দেশ্যে উত্সর্গ করেন। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা পশু উত্সর্গ করে নৈশভোজের আয়োজন করেন। তাতে আত্মীয়স্বজন, গরিব-দুঃখীসহ সকলেই অংশগ্রহণ করেন। সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারীগণ মনসা ও কালিপূজা উপলক্ষে পশু উত্সর্গ করেন। এভাবে দেখতে গেলে সকল ধর্মের সারকথা একই। ধর্মের উত্সমূল এক বলে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য এবং বিলিয়ে দেওয়াই এখানে আসল কথা। অর্থাত্ পশু কোরবানির মাধ্যমে নিজের মধ্যে থাকা পশুত্বের অবসান এবং পূত-পবিত্র হয়ে (যেভাবে পশুর রক্ত বয়ে গিয়ে তার মাংস পবিত্র হয়) সৃষ্টিকর্তার প্রিয় বান্দা হওয়া। অন্যদিকে মাংস বিতরণের মাধ্যমে অন্যকে আনন্দে শামিল করা। কেননা অন্যের আনন্দ ব্যতীত নিজের আনন্দ কখনো পূর্ণতা পায় না।
অতএব, ঈদুল আজহার শিক্ষা হলো আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর ন্যায় একজন মুসলিমের যেকোনো সময় যেকোনো ত্যাগ-স্বীকার করতে প্রস্তত থাকা। হযরত ইসমাইল (আ)-এর ন্যায় আল্লাহর নির্দেশ মাথা পেতে মেনে নেওয়া ও তা পালনে আনন্দিত হওয়া। বাবা-মায়ের ন্যায়সঙ্গত আদেশ পালন করা এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে দূরে থাকা। হযরত হাজেরা (আ)-এর ন্যায় দৃঢ়চেতা মুমিন নারীর পরিচয় দেওয়া। তাছাড়া আশারাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পশু-পাখি ও জীবজন্তুর প্রতি মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেও এসবের মালিকানা যে আল্লাহর তা সর্বদা স্মরণে রাখা এবং হালাল প্রাণী জবেহ’র সময় আল্লাহর নাম নেওয়া। আমরা এবারের ঈদুল আজহা শান্তিপূর্ণ ও উত্সবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা রাখি।
লেখক :সাংবাদিক