সোমবার, ২৯শে অক্টোবর, ২০১৮ ইং ১৪ই কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

এখনও নিখোঁজ তিন সৌদি রাজপুত্র

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সৌদি আরব সরকারের সমালোচনা করায় ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপে বসবাসরত তিন রাজপুত্র এখনও নিখোঁজ আছেন। তাদের প্রত্যেককেই অপহরণ করে দেশটিতে ফিরিয়ে আনার প্রমাণও আছে। কিন্তু তারপর তাদের সম্পর্কে আর কিছুই জানা যায়নি।

সুলতান বিন তুর্কি বিন আব্দুল আজিজ

২০০৩ সালের ১২ জুন সকালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের বাইরে একটি প্রাসাদে ঢুকতে দেখা যায় সৌদি রাজপুত্র সুলতান বিন তুর্কি বিন আব্দুলআজিজকে। প্রাসাদটি ছিল তার আত্মীয় প্রয়াত সৌদি বাদশাহ ফাহাদের।

ফাহাদের ছেলে রাজপুত্র আবদুলআজিজ বিন ফাহাদের সঙ্গে সকালের নাস্তা খেতে প্রাসাদে যান সুলতান। একপর্যায়ে সমালোচক সুলতানকে সৌদি আরবে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন আব্দুলআজিজ। সুলতান ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানালে তখন আব্দুলআজিজ একটি ফোন করতে যান।

তখন ওই কক্ষে থাকা দ্বিতীয় ব্যক্তি, সৌদি আরবের ইসলাম ধর্ম বিষয়কমন্ত্রী শেখ সালেহ আল-শেখ কক্ষ ছেড়ে চলে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখোশ পরা কয়েকজন ঘরে ঢুকে এবং সুলতানকে অজ্ঞান করে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়।

অজ্ঞান অবস্থায় সুলতানকে জেনেভা বিমানবন্দরে নেয়া হয় এবং সেখানে অপেক্ষারত একটি বিমানে ওঠানো হয় তাকে। অনেক বছর পর সুইজারল্যান্ডের একটি আদালতে ঠিক এভাবেই সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন সুলতান।

পরে জেনেভার হোটেলে থাকা সুলতানের সঙ্গীদের জানানো হয় যে, সুলতানকে রিয়াদ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাই তাদের আর কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু সুলতান কী এমন করেছিলেন যে তাকে এভাবে অপহরণ করতে হলো?

সৌদি আরবে ফেরার পর সুলতানের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় তাকে কারাগারে এবং ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। দীর্ঘসময় কারাগারে এবং বাড়িতে আটক থাকার পর সুলতানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে সম্মত হয় রাজপরিবার।

২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে সুইস আদালতে আব্দুলআজিজ বিন ফাহাদ এবং শেখ সালেহ আল-শেখের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করেন সুলতান। প্রথমবার কোনও সৌদি রাজপরিবারের সদস্যের আরেক রাজপরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে পশ্চিমা আদালতে মামলা করার ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপ যান সুলতান। ইউরোপে পৌঁছানোর পর থেকেই সৌদি সরকারের সমালোচনা করে বিভিন্ন ইউরোপীয় গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করেন সুলতান। এসব সাক্ষাৎকারে রাজপরিবারের সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন তিনি।

এরপর ২০১৬ সালে সুলতান এবং তার ১৮ জন সফরসঙ্গীকে প্যারিস থেকে কায়রো নিয়ে যাওয়া হবে বলে একটি বিমানে উঠিয়ে রিয়াদে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকে আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি সুলতানের।

তুর্কি বিন বান্দার

রাজপুত্র তুর্কি বিন বান্দার একসময় সৌদি পুলিশের একজন মেজর ছিলেন। তিনি রাজপরিবারের সদস্যদের পুলিশি সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়লে একসময় কারাদণ্ড দেয়া হয় তাকে।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ২০১২ সালে প্যারিসে চলে যান তিনি। সেখানে গিয়েই সৌদি আরবের সংস্কার চেয়ে ইউটিউবে ভিডিও পোস্ট করা শুরু করেন তিনি। রাজপুত্র সুলতানের মতো তুর্কিকেও আলোচনার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে সৌদি কর্তৃপক্ষ।

তবে আলোচনার মাধ্যমে রাজপুত্র তুর্কির মন গলাতে ব্যর্থ হয় সৌদি সরকারি কর্মকর্তারা। ২০১৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ইউটিউবে ভিডিও পোস্ট করে যান তুর্কি। সেই বছরের শেষের দিকে হঠাৎ উধাও হয়ে যান তিনি। তারপর এখন পর্যন্ত রাজপুত্র তুর্কি বিন বান্দার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

সউদ বিন সাইফ আল-নাসের

রাজপুত্র তুর্কি নিখোঁজ হওয়ার কাছাকাছি সময় একই ধরনের পরিণতি হয় আরেক রাজপুত্র সউদ বিন সাইফ আল-নাসেরের। ইউরোপে বিলাসবহুল জীবনযাপনে উৎসাহী ছিলেন এই রাজপুত্র। ২০১৪ সাল থেকে টুইটারে সৌদি রাজতন্ত্রকে কটাক্ষ করে পোস্ট দিতে শুরু করেন তিনি।

পরের বছর বাদশাহ সালমানকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে লেখা অজ্ঞাতনামা এক সৌদি রাজপুত্রের দুটি চিঠি ফাঁস হয়। তার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন সউদ। এক টুইটে চিঠি দুটির বিষয়বস্তুকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে সৌদি জনগণকে আহ্বান জানান তিনি। এর কিছুদিন পর থেকে তার টুইটার অ্যাকাউন্টটি নিরব হয়ে যায়।

জার্মানিতে পালিয়ে যাওয়া আরেক সৌদি রাজপুত্র খালেদ বিন ফারহানের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক বৈঠকের কথা বলে কৌশলে সউদকে রিয়াদে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সৌদি রাজতন্ত্রের সমালোচনা করা আমরা চারজনই ছিলাম ইউরোপে, যাদের মধ্যে তিনজনকেই অপহরণ করা হয়েছে।

রাজপুত্র খালেদ আশঙ্কা করছেন অল্প সময়ের মধ্যেই হয়তো তাকেও অপহরণ করা হতে পারে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।