ঢাকার বাস-মিনিবাসের ফিটনেস-চালক কোনোটিই ঠিক নেই
নিউজ ডেস্ক : বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় একরকম শীর্ষে থাকা ঢাকার মানুষের প্রধান যানবাহন বাস-মিনিবাস। আর রাজধানী শহরের এই বাহনের বেশিরভাগেরই ফিটনেস বা চালক কোনোটিই ঠিকঠাক নেই।
পুরোনো গাড়ি রঙ করলেই ঢাকার রাস্তায় হয়ে যায় নতুন। আবার কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেওয়া হয় সড়কে চলাচলের অনুমোদন (রুট পারমিট)। এমনকি রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি’র বাসেরও ফিটনেস নেই। দীর্ঘ দিনের পুরনো বিআরটিসি’র দ্বিতল বাসগুলো লক্কড়ঝক্কড়। তা নিয়ে সমালোচনারও শেষ নেই যাত্রীদের মধ্যে।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরে গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে সবার আগে বিআরটিএ’র সংস্কার করা জরুরি। তবেই যানবাহনে সবরকম ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে।
তথ্যমতে, ফিটনেসবিহীন বাস ও চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে প্রায় ৮০ ভাগ দুর্ঘটনাই ঘটে।
সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতে তরুণ প্রজন্ম জেগে উঠেছিল। এ আন্দোলনে ঢাকার রাস্তায় নতুন চেহারাও এসেছিল কিছুটা। কিন্তু তা কয়েকদিনই ছিল। এরপর অবার যেই সেই। পুনরায় পুরনো চেহারা ফিরে পায় নগরী।
গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হলেও কর্তৃপক্ষ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন আনতে পারেনি। এজন্য কারওয়ান বাজারে দুই বাসের প্রতিযোগিতায় ভুক্তভোগী রাজীবের কাটা হাতের ছবিটিকে বাংলাদেশের সড়ক পরিবহনের অবস্থার একটি প্রতীকী বলা যায়।
বেশির ভাগ বাসেরই বাইরের রঙ-বাকল অক্ষত নেই। আড়াআড়িভাবে প্রতিযোগিতা করে বাস চালানোর কারণেই বাসের চেহারা দেখতে অনেক অমলিন।
পরিবহন মালিকরা রুট পারমিটের আবেদন করার পর ট্রাফিক পুলিশ ও মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধির মতামত এবং আবেদনকারীর প্রভাব- এই তিনটি বিষয়ই সবচেয়ে বেশি বিবেচনা করা হয়। মালিক প্রভাবশালী হলে পুরাতন গাড়ি রঙ করেই নামিয়ে দেন রুটে। এক্ষেত্রে গাড়ির ফিটনেস আছে কি-না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কোনো প্রয়োজনই পড়ে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) এক বছর নয় মাসের ঢাকার সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ২২৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২১৫ জন। এর মধ্যে পথচারী নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। শতকরা হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী নিহত হওয়ার সংখ্যা ৩৯ ভাগ। ২০১৭ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ২৬৭টি। মারা গেছেন ২৮০ জন। এর মধ্যে পথচারী ১৩০ জন। এ হিসাবে ৪৬ ভাগ পথচারী। আর এসব দুর্ঘটনার জন্য ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতাকেই দায়ী করা হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, ঢাকা ও এর আশপাশে ২৪৬টি রুটে সাত হাজার ৯৩৭টি বাস-মিনিবাস চলাচল করে। বাস মালিক আছেন প্রায় তিন হাজার। অনেক মালিকের মাত্র একটি বাস আছে, কারও কারও আছে দুই থেকে তিনটি।
রাজধানীর বাস-মিনিবাসের মধ্যে কি পরিমাণ গাড়ির ফিটনেস সনদ নেই, তার সঠিক তথ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ’র কাছেও নেই। তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির জরিপের তথ্যমতে, বিআরটিএ নিবন্ধিত মোট পরিবহনের ৪০ শতাংশই ফিটনেসবিহীন।
বিআরটিএ’র তথ্যমতে, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ফিটনেস নবায়ন না করা যানবাহনের সংখ্যা ৫৫ হাজার। তবে সেখানে বাস-মিনিবাস কতটি রয়েছে, এটার আলাদা কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিআরটিএ’র হিসাবে, ঢাকায় বাস-মিনিবাসের নিবন্ধন ৩৫ হাজারের মতো। অর্ধেকের বেশি ঢাকার বাইরে চলে। কিছু অকেজো হয়ে বাতিল হয়ে গেছে। এই নিবন্ধিত বাস-মিনিবাসের মধ্যে সাড়ে ১৮ হাজারের ফিটনেস হালনাগাদ নেই। এর মধ্যে অন্তত পাঁচ হাজার মিনিবাস রয়েছে। ফিটনেসবিহীন এসব মিনিবাসের প্রায় সবই ঢাকায় চলছে।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী শিফুন নেওয়াজ বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণপরিবহনের ফিটনেস প্রতি বছরই নিতে হয়। আবার গাড়ির বয়স ১৫ বছর পার হলে ছয় মাস পর পরই গণপরিবহনের সনদ নিতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে গাড়িগুলো প্রতি বছর ফিটনেস সনদ নেয় না।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে যদি ১০ বছর বয়সী গণপরিবহনের ফিটনেসের সনদ ছয় মাস পর পর নেওয়া বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়, আর ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে পাঁচ বছর পর পর ফিটনেস সনদ নিতে বাধ্য করা হয়, তখন দুর্ঘটনা অনেকটা কমে আসবে। আর ফিটনেস সনদ না নিলে মামলা দিতে হবে। মনিটরিং জোরদার করতে হবে। তাহলে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে। বাংলানিউজ