‘সেক্স’ আর ‘সেক্সুয়ালিটি’ কি এক?
লাইফস্টাইল ডেস্ক : ‘ইন্টুবিন্টু’ শব্দটাকে মনে আছে? যে কোনও প্রকারের সেক্সুয়াল ইনুয়েন্ডোকে বোঝাতে বাঙালি এই সেদিনও এই শব্দটাকে হুড়ুদ্দুম ব্যবহার করেছে। ন’পাড়ার ভজার সঙ্গ আটাপাড়ার ঝিমলির আশনাই বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহৃত হতো। আবার ভূগোল স্যারের নজর এড়িয়ে ক্লাস সেভেন ডি-র ব্যাক বেঞ্চে বসে কামদেব অথবা রসময় গুপ্ত বিরচিত পানুকাহিনির সম্মিলিত পাঠ গ্রহণকেও এই শব্দ দিয়েই বোঝানো হতো। বাঙালির যৌন ভোকাবুলারি কোনও দিনই তেমন তন্দুরস্ত নয়। অল্প কথায় অধিক কাজের মহত্ব নয়, বাঙালি এই একটা ব্যাপারে চিরভিখিরি। কবিতা লিখতে গেলে বাঙালির শব্দে ভাটা পড়ে না, ট্রামে বাসে ঝগড়া করতে গেলে বাঙালির শব্দভাণ্ডার উথলে ওঠে। কিন্তু সিরিয়াস যৌনজ্ঞানের প্রকাশেই বাঙালি অকারণে চঞ্চল। সেখানেই বাঙালির যাবতীয় ইকির-মিকির চাম-চিকির ফুটুড্ডুম হয়ে খাল্লাস।
তা হলে কি বাঙালির যৌনজ্ঞানেই খামতি? বিসমিল্লায় গলদ? বাঙালি যৌন বিষয়ে কথা বলতে গেলেই ইংরেজি ভাষার আশ্রয় নেয়। প্রকৃত শব্দে নিজের যৌনজীবনকে ব্যক্ত করা দূর অস্ত, চিকিৎসকের কাছে গিয়েও বাঙালি নিজের যৌনাঙ্গের নামও ইংরেজিতে বলে। ডাক্তারও কদাচ বাংলায় উচ্চারণ করেন না সেইসব শব্দ। বাঙালির জীবনে ‘সেক্স’ যতটা সহজলভ্য, যৌনতা ততটা নয়।
এই কিছুদিন আগেও বাঙালি স্কুলে যৌনশিক্ষা পড়ানো নিয়ে ধুন্ধুমার ক্যাঁওম্যাও করেছে। ‘যৌনশিক্ষা’-র নাম ‘জীবনশৈলী’ রেখেও সামলানো যায়নি ঝামেলা। ভাবলেও ভিরঘুট্টি লাগে, কোথায় ‘যৌনশিক্ষা’ আর কোথায় ‘জীবনশৈলী’। জানতে ইচ্ছে করে, এই মহান টার্মিনোলজিটি কার বা কাদের মস্তিষ্ক প্রসূত? আর জানতে ইচ্ছে করে, এতদিন পরে, এই একুশ শতকে এসে বাঙালির টনক নড়ল যে তার ‘যৌনশিক্ষা’ প্রয়োজন? এতদিন, সেই অনাদিকাল থেকে সে ‘অশিক্ষিত’ যৌনাচারেই অভ্যস্ত ছিল, এই বার সে ‘শিক্ষিত’ যৌনাচারী হতে চায়। আর আশ্চর্য ব্যপার, এই বেহুদো আবদারে কেউ একটুও হাসলেন না। সবাই সিরিয়াস মুখেই মেনে নিলেন এই ‘যৌনশিক্ষা’-র ব্যাপারটা।
১৯৬০-এর দশকে বাংলা বাজারে উদ্ভূত হয়েছিল ‘নরনারী’, ‘রুপোলী প্রজাপতি’ নামের বিবিধ ‘অ্যাডাল্ট’ পত্রিকা। সেই সব পত্রিকায় পর্নোগ্রাফিক এলিমেন্টের পাশাপাশি যৌনশিক্ষারও বন্দোবস্ত থাকত। কিন্তু খুব বেশিদিন সেসব চলেনি। পুলিশি ধরপাকড়, রাজনৈতিক পালাবদল ইত্যাদি কারণে সেই সব পত্রিকার অকালে এন্তেকাল হয়। বাঙালির যৌনশিক্ষাও কেমন একটা বেপথু হয়ে পড়ে। ১৯৮০-র দশকে ফরম্যাট বদলে ‘সত্যকাহিনি’ টাইপের পত্রিকা আবির্ভূত হয়। সেখানেও থাকত ‘শারীরিক প্রশ্নোত্তর’। পরে তা প্রথম সারির পারিবারিক পত্রিকাতেও উঠে আসে। কিন্তু সেই সব নিয়েও দেদার ইনহিবিশন ছিল বাঙালি মধ্যবিত্তের। যতটা না ‘শিক্ষা’র জন্য সে সব পাঠ করতে বাঙালি, তার চাইতেও অধিক মাত্রায় সে ‘ইন্টুবিন্টু’ খুঁজত সেই সব পাতায়।
গোলযোগ সব থেকে বেশি দেখা দেয় ১৯৯০ দশকের মধ্যভাগে। সেই সময়ে সাগরপারের এক বহু পুরাতন হাওয়া বাঙালির পালে এসে লাগে। বাঙালির যৌনজ্ঞানের ভাঁড়ারের দৈন্য আবার নতুন করে বোঝা যায়। এইসময়ে বাঙালির আকাদেমিয়া পরিচিত হয় ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো ও তাঁর যৌনতা-সংক্রান্ত সন্দর্ভের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পাঠক্রমে তিনি তখনও অন্তর্ভুক্ত নন। কিন্তু বিশ্বিদ্যালয়ের লনে-ক্যান্টিনে তিনি অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠেন। ফুকোকে ঘিরে সত্য-মিথ্যা-মিথ সবরকমই চর্চিত হতে থাকে। ফুকো মূলত পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম নামক দার্শনিক মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা। তিনি ব্যতিরেকে আরও বেশ কয়েকজন মহারথী সেই মতবাদকে পুষ্ট করেছেন। কিন্তু তাঁদের সক্কলের চাইতে বেশি ড্রপ খেয়েছিল ফুকোর নাম। বাংলা বাজারে চাউর হয়েছিল, এই সাহেব নাকি ‘যৌনতার ইতিহাস’ লিখেছেন। বাঙালি বিবুধ সমাজ এতেই উতরোল। ১৯৯০-র দশকের গোড়ায় বাঙালি নতুন একটা শব্দ লাভ করে— ‘সেক্সুয়ালিটি’। বাজারে তাপ ও ভাপ বাড়তে শুরু করে।
সেই সময়ে ফুকোকে নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ আর বই বাজারে লেখা হয়। তার সবক’টা জালি ছিল, একথা একবারেও বলছি না। সেই সময়ে অভিজিৎ চক্রবর্তী ফুকোর একটা লিটারারি বায়োগ্রাফি লেখেন, যা সত্যিই আজও এই বিষয়ে খুব প্রয়োজনীয় বই। ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে অমল বন্দ্যোপাধ্যায় ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় লেখেন ‘মিশেল ফুকো বা মানুষের অন্তর্ধান’ নামের এক প্রবন্ধ। এতে সরাসরি ফরাসি সূত্র থেকে লেখা হয় ফুকোর তত্ত্ববিশ্ব সম্পর্কে। এই দুই রচনাতেই ফুকোর ‘হিস্টরি অফ সেক্সুয়ালিটি’ নিয়ে পরিষ্কার আলোচনা ছিল। কিন্তু কফিহাউজ বা চায়ের ঠেক কাঁপানো বাঙালি আঁতেলেকচুয়াল সে সবের ধার ধারেননি। ‘যৌনতার ইতিহাস’ সম্পর্কে পল্লবিত হতে থাকে গুজবের ভাবতরঙ্গ। এমনও জানা যেতে থাকে, এই বইতে নাকি ফুকো সাহেব পশ্চিমী কামসন্দর্ভ খুলেখেলে লিখে গিয়েছেন। পড়লেই ক্যান্টার ‘ইন্টুবিন্টু’।
সেক্স আর সেক্সুয়ালিটি ক্রমাগত গুলিয়ে যেতে থাকে বাংলা বাজারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাঙালির অভিধানে ‘সেক্সুয়ালিটি’ মালটিই ছিল না। ১৯৯০ দশকের গোড়ায় সেই শব্দ বাঙালির তপ্ত যৌবনে খই ফুটিয়ে ছাড়ে। বাঙালির একটা বড় অংশ ভাবতে শুরু করে, সেক্সুয়ালিটি বস্তুটি সেক্স-এর বড় ভাই। অনেকে এমনটাও মনে করতে শুরু করে, ‘সেক্স’ নামক বস্তুটি নেহাতই পুরনো, আউট অফ ফ্যাশন। লেটেস্ট মাল হল ‘সেক্সুয়ালিটি’। আক্ষরিক অর্থে ‘পোস্ট মডার্ন’ হয়ে উঠতে গেলে ‘সেক্সুয়ালিটি’-ই দস্তুর। ‘সেক্স’ দিয়ে যা হবে না, সেখানে সেক্সুয়ালিটিই একমাত্র উপায়।
অথচ এটা কেউ ভেবে দেখল না, আলু আর আলুবোখরা যেমন এক নয়, বর যেমন কিছুতেই বরযাত্রী নয়, সেক্স ও কিছুতেই সেক্সুয়ালিটি এক নয়। ফুকো তাঁর তিন ভলিউম ‘হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটি’ ও মার্কিন দার্শনিক আর্নল্ড ডেভিডসন তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘দ্য ইমারজেন্স অফ সেক্সুয়ালিটি’-তে বিপুল যত্নে বিবৃত করেছিলেন সেক্সুয়ালিটি বিষয়ক সন্দর্ভ। ফুকো তাঁর তিন খণ্ডে জানান, সেক্সুয়ালিটি এক জ্ঞানধারণা। আর সেক্স এক শরীরী ক্রিয়া, যাকে অপারেট করে সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতি ইত্যাদি প্রভৃতি। বাঙালির ধারণাজগতে বিরাজমান কামকেলি আর ইন্টুবিন্টুর কনসেপ্টে এহেন সন্দর্ভ ফিট করানোই দুরূহ।
ফুকো দেখান, ১৮ শতকের পশ্চিমী জ্ঞানদীপ্তি তার আগেকার যাবতীয় ধারণাগুলিকে আক্রমণ করে এবং তার নিজস্ব জ্ঞানকাণ্ডকে সবকিছুর উপরে চাপিয়ে দিতে চায়। এর ফলে একে একে ধ্বংস হয়ে যায় বহু প্রাচীন জ্ঞান। যৌনতা সংক্রান্ত প্রাচীন ও বহুমুখী ধারণা সমূহকে দমিয়ে জ্ঞানদীপ্তি লাগু করে সেক্সুয়ালিটির ধারণা। ডেভিডসনের গবেষণায় দেখা যায়, এই ধারণার পিছনে কাজ করে চর্চা-বিষয় হিসেবে অ্যানাটমি, প্যাথলজি এবং সাইকোলজির উদ্ভব। এই তিন বিষয়েই গড়ে তোলে যৌনতা সংক্রান্ত বিজ্ঞানসম্মত বাচন ‘সেক্সুয়ালিটি’। সেক্সুয়ালিটির জারণ চলে ১৯ শতকের গোড়া থেকে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত। এটা একান্ত ভাবেই এক পশ্চিমী ধারণা, পরে তা ভারতের মতো উপনিবেশে চেপে বসে। এই চেপে বসার পিছনে কাজ করেছে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, গণস্বাস্থ্য নিয়ে ঔপনিবেশিক প্রভুদের মাথাব্যথা ইত্যাদি বহু বিষয়। ফুকো জানান, প্রাচ্যের ‘কামকলা’-কে ধ্বংস করে ‘সেক্সুয়ালিটি’ বা তাঁর ভাষায় ‘সায়েন্টিয়া সেক্সুয়ালিস’। বাৎস্যায়নের ঘাড়ে চেপে বসেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড বা হ্যাভলক এলিস।
বাঙালির কী বা বাৎস্যায়ন, কী বা ফ্রয়েড। তার সেই একটাই রা— ইন্টুবিন্টু। সেক্স নিয়ে বাঙালি সিলি জোক যত বেশি চালাচালি করে, যৌনতা নিয়ে সিরিয়াস ভাবনা কি ততটা তন্দুরস্ত তার? পশ্চিম থেকে চুঁইয়ে নামা যৌনতার ঝিলিক নিয়েই তার দিন কেটে যায়। সে না পড়েছে বাৎস্যায়ন, না তাকিয়েছে ফুকো-ডেভিডসনের দিকে। মানলাম, এসব পণ্ডিতের কাজ। কিন্তু বাংলায় এই বিষয় নিয়ে বুঝভুম্বুল দূর করতে ক’জন পণ্ডিত এগিয়ে এসেছেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙালি জেন্ডার ইকুয়ালিটি, এজিজম, সেক্সিজম নিয়ে হেজিয়ে লাট। এলজিবিটি নিয়ে সে রাস্তায় নামতে পারে, প্রকাশ্যে চুম্বনের অধিকার নিয়ে ধামাল মচাতে পারে, কিন্তু সেক্স আর সেক্সুয়ালিটির ফারাক জানতে চাইলেই সে ধাঁ। বিশ্বাস না হয়, কারওকে প্রশ্ন করেই দেখুন না, খেলা কোথায় গড়ায়।