বাবা মায়েদের মুখে হাসি, থাইল্যান্ড জুড়ে আনন্দ
পুরো বিশ্ব তাকিয়ে ছিল অভিযানটির দিকে। অভিযান সফল হবার পর এখন থাইল্যান্ড জুড়ে আনন্দ ও স্বস্তির নি:শ্বাস বয়ে যাচ্ছে। বালকদের খুঁজে পাওয়ার পর হতে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন প্রিয়জনেরা। এবার সন্তানদের নিরাপদে ফিরে পেয়েছেন তারা। গত ২৩ জুন ওয়াইল্ড বোয়ার নামের এক ফুটবল দলের ১২ কিশোর ও তাদের কোচ গুহাটিতে প্রবেশের পর নিঁখোজ হয়। অবশেষে গুহায় আটকে থাকার ১৭ দিন পর তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হল।
ঘটনার শুরু যেভাবে:
কিশোরদের মুখের সত্যতা ছাড়া কেন তারা গুহায় গিয়েছিল তা জানা সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, এক বন্ধুর জন্মদিনের সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করতে তারা গুহার ভিতরে ঢুকেছিল। এরপর প্রচণ্ড বৃষ্টিতে পানি জমে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। কিশোররা কেউ সাঁতার জানতো না। তাই তাদের বেরুবার পথ ছিল না। তবে তাদের কাছে খাবার ও পানীয় ছিল।
থাম লুয়াং-খুনাম নাঙ্গনন ন্যাশনাল পার্কের একজন কর্মী গুহার বাইরে সেদিন কিশোরদের সাইকেল দেখতে পান। অসুস্থতার কারণে ওই দিন বন্ধুদের সাথে যোগ দিতে না পারা এক বন্ধুও বলেছে, আগে অনেকবার তারা গুহায় গিয়েছিল তবে বর্ষাকালে তাদের ভেতরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। বাসায় না ফেরায় অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে থাকেন। কিশোররা গুহায় আটকা আছে অনেকটা নিশ্চিত হবার পরই উদ্ধার অভিযান শুরু করা হয়।
গুহা বৃত্তান্ত :
থাম লুয়াং গুহা ১০ হাজার ৩১৬ মিটার লম্বা ও থাইল্যান্ডের চতুর্থ বৃহৎ গুহা। পর্যটকদের জন্য এটি খুবই জনপ্রিয় তবে বর্ষাকালে মৃত্যুফাঁদ। অতীতেও আরো কিছু লোক গুহাটিতে নিখোঁজের খবর পাওয়া গেছে। গুহার ভিতরে সংকীর্ণ হওয়ায় উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছে ডুবুরিদের।
বালকদের প্রথম খোঁজ:
বেশকিছু দিন নিঁখোজ কিশোরদের সন্ধান না মিললে থাই নেভি সিলদের পাশাপাশি বিদেশি ডুবুরিরা উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া শুরু করে। থাই কিশোরদের নিঁখোজ হবার নয়দিন পর ২ জুলাই রাতে ২ জন ব্রিটিশ ডুবুরি রিচার্ড স্ট্যানটন ও জন ভলানথেন তাদের খুঁজে পান। এরপরই থাইল্যান্ড সরকার কিশোর ও তাদের কোচকে উদ্ধারে চূড়ান্ত অভিযান শুরু করে।
উদ্ধার পরিকল্পনা ও প্রতিকূলতা:
প্রাথমিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল কিশোরদের কাছে বর্ষাকাল শেষ হবার আগ পর্যন্ত খাবার দাবার রেখে আসা হবে। বর্ষার মৌসুম শেষ হলে উদ্ধার করা হবে তাদের। কিন্তু পরবর্তীতে বৃষ্টির পানি বৃদ্ধি ও বন্যার আশংকায় দ্রুত অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বালকদের চিঠি:
গুহায় আটকে থাকা অবস্থা থাই কিশোররা তাদের বাবা মায়ের কাছে বেশ কিছু চিরকুট পাঠায়। ৬ জুলাই পাঠানো সেসব চিরকুটে ফিরে আসার আশ্বাস ও কিশোরদের নানান আবদার ফুটে উঠে। একটি চিঠিতে বাবা-মায়েদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ‘চিন্তা করো না। আমরা সবাই ভালো আছি।’
শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে মজা করে কেউ একজন লিখেছে, ‘দয়া করে, আমাদের আর বেশি বেশি বাড়ির কাজ দিবেন না।’ এছাড়া, একটি চিঠিতে থাই কিশোরদের কোচ নিজের ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন। যদিও বাবা মায়েরা জানিয়েছে তারা কোচের উপর রাগ করেনি।
অভিযান:
রবিাবর (৮ জুলাই) প্রথম দিনের অভিযানে, ধারণা করা সময়ের বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে কিশোরদের ৪ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। দ্বিতীয় অভিযানের পূর্ণ প্রস্তুতির জন্য অভিযান স্থগিত করা হয় ১০ ঘণ্টা। এ সময় উদ্ধার হওয়া বালকদের চিয়াং রাইয়ের একটি হসপিটালে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। উদ্ধার করা কিশোরদের মধ্যে দুর্বলদেরই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছিল। সোমবার (৯ জুলাই) দ্বিতীয় দফায় আরো ৪ বালককে গুহা থেকে উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার (১০ জুলাই) উদ্ধার অভিযানের তৃতীয় দিনে কোচসহ বাকি ৪ জনকে উদ্ধার করা হয়। আবহাওয়া খারাপ থাকায় শেষদিন উদ্ধার অভিযানে বিলম্ব হচ্ছিল। বাড়ানো হয়েছিল উদ্ধারকারী ডুবুরির সংখ্যাও।
আন্তর্জাতিক তৎপরতা:
থাই বালকদের নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল থেকে তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তার দেশ ঘনিষ্ঠভাবে থাই কিশোরদের উদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছে। স্পেএক্স এর সিইও, তার কোম্পানির পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবার চেষ্টা করেছেন। যুক্তরাজ্যের ডুবুরিরা, থাই নেভি সিলের সাথে সার্বক্ষণিক কাজ করে গেছেন। সিএনএন, বিবিসি, গার্ডিয়ান, আল-জাজিরাসহ বিশ্বের সবগুলো প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যম ঘটনাটি সরাসরি সম্প্রচার করে।
একটি দু:খজনক ঘটনা:
জটিল এই উদ্ধার অভিযানে একমাত্র দু:খজনক ঘটনা থাই ডুবুরি সামান কুনান এর মৃত্যু। উদ্ধার অভিযানের একপর্যায়ে থাই নেভি সিলের অবসরপ্রাপ্ত এই সদস্য কিশোরদের অক্সিজেন সরবরাহ করে ফেরার পথে অক্সিজেন-স্বল্পতায় মারা যান।
ফিফার আমন্ত্রণ:
কিশোররা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে এ মাসের ১৫ জুলাই রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটি তাদের দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছে ফিফা। ফুটবল দলের সদস্যরা ও তাদের কোচের জন্য এটি নি:সন্দেহে আনন্দের খবর!
বালকদের পরিচয়:
চানিন ভিবনরুনগ্রুয়াং: বয়স ১১ বছর। ডাক নাম তিতান। আটকে পড়া ফুটবল টিমের মধ্যে সবার ছোট সে।
পানুমাস সাংদি: বয়স ১৩ বছর। ডাক নাম মিগ।
দুগানপেত প্রমতেপ: বয়স ১৩ বছর। ডাক নাম দম।
সামপং জাইওয়ং: বয়স ১৩ বছর। ডাক নাম পং।
মংকল বুনিয়াম: বয়স ১৩ বছর। ডাক নাম মার্ক।
নাত্তাউত তাকামরং: বয়স ১৪ বছর। ডাক নাম টির্ন।
একারাত ওংসুকচান: বয়স ১৪ বছর। ডাক নাম বিউ।
আদুল স্যাম-অন: বয়স ১৪ বছর। মিয়ানমারের বংশোদ্ভূত। কয়েকটি ভাষায় কথা বলতে পারে সে। সেই দলের একমাত্র সদস্য যে তাদের সন্ধান পাওয়া ব্রিটিশ ডুবুরিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে।
প্রাজাক সুথাম: বয়স ১৫ বছর। ডাক নাম নোট।
পিপাত ফো: বয়স ১৫ বছর। ডাকনাম নিক।
পনচাই কামলুয়াং: বয়স ১৬ বছর। ডাকনাম তিই।
পিরাপাত সোমপিয়াংজাই: বয়স ১৭ বছর। ডাক নাম নাইট। যেদিন তারা গুহায় আটকে পড়ে অর্থাৎ ২৩ জুন তার জন্মদিন ছিল। তার জন্মদিন উদযাপনের জন্য সবাই যে খাবারগুলো এনেছিল, সেগুলোই তাদের এতদিন টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। তার বাবা-মায়েরা ছেলের উদ্দেশে চিঠিতে লিখেছে, সে ফিরে আসার পর জন্মদিনের পার্টি হবে। এজন্য তারা অপেক্ষা করছে।
এক্কাপোল জানথাওং: বয়স ২৫ বছর। ডাকনাম এক। সে ফুটবল দলের সহযোগী কোচ। উদ্ধারকারীদের মতে, তিনি সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় আছেন। কারণ তিনি বার বার খাবার খেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং তার পরিবর্তে সেগুলো ওই কিশোরদের খেতে বলেছেন।