স্পোর্টস ডেস্ক :শান্ত, স্থির ও নিরিবিলি গ্রাম রাজশাহীর দুর্গাপুরের ক্ষুদ্র কাশিপুর। সেই গ্রামের ভেতর দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে পিচ ঢালা সরু পথ। গ্রামের চারপাশে ফসলি জমি আর ঘন আমবাগানের সারি। ছায়াঘেরা নিবিড় শান্ত এই গ্রামে এখন উৎসবের আমেজ।
কারণ তাদের গাঁয়ের মেয়ে মার্গারিতা মামুন অলিম্পিকের মতো বড় আসরে অংশ নিয়ে রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে সোনা জিতেছে। মার্গারিটা মামুনের সেই গৌরবগাঁথা অর্জন বিশ্ব আসন কাঁপিয়ে তার আনন্দের ঢেউ ছোট্ট এই কাশিপুর গ্রামেও লেগেছে।
মার্গারিটা মামুন রাশিয়ার হয়ে অলিম্পিকে অংশ নিলেও মূলত তার শিকড় এই ক্ষুদ্র কাশিপুর গ্রামেই। তার বাবা আবদুল্লাহ আল মামুন এই গ্রামের সন্তান। বেড়ে উঠা ও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা এই গ্রামেই। রিটার শরীরে প্রবাহমান সেই মামুনের রক্ত। তাইতো ক্ষুদ্র কাশিপুরের মানুষেরা মামুনের মেয়েকে তাদের নিজেদের মেয়ে মনে করেন। প্রবল আগ্রহ নিয়ে খেলা দেখেছেন রাত জেগে।
রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার পূর্বদিকে ও দুর্গাপুর উপজেলা থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত ক্ষুদ্র কাশিপুর গ্রাম। এই গ্রামের সন্তান আব্দুল্লাহ আল মামুন। গ্রামের লোকেরা তাকে ‘শিপার’ নামে ডাকে। চার বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট মামুন।
মামুনের পরিবারের সদস্যরা জানান, দুর্গাপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করে একাদশ শ্রেণিতে রাজশাহী কলেজে ভর্র্তি হয় মামুন। ওখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। কিন্তু লাশকাটা ঘরের কথা ভেবে তিনমাসেই ডাক্তারি পড়া থেকে মন উঠে যায় মামুনের। শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ১৯৮৩ সালে চলে যান রাশিয়ায়। সেখানে রুশ কন্যা আন্নাকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেই মামুন-আন্না দম্পত্তির ঘরেই ১৯৯৫ সালের ১ নভেম্বর মস্কোতে জন্ম নেন কন্যা রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে সোনাজয়ী মার্গারিটা মামুন। পরে তাদের দ্বিতীয় সন্তান ফিলিপ আল মামুন জন্ম নেয়।
দুর্গাপুরের গ্রামে রয়েছে মামুনের বাবার আমলের একটি পুরনো মাটির বাড়ি। এরপাশেই রাশিয়া থেকে ছুটিতে এসে তৈরি করেছেন একতলা ফ্ল্যাট বাড়ি। এবাড়িতে প্রতিবছরই আসতেন মামুন। সঙ্গে স্ত্রী ও সন্তানরাও আসতেন। কন্যা মার্গারিটা মামুন এসেছেন এ পর্যন্ত তিনবার। কিন্তু দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় গত তিন বছর ধরে আর বাড়িতে আসতে পারছেন না মামুন।
রিটার বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুনের বড় ভাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এএসএম খসরু জানান, তাদের বাবা মৃত আব্দুল খালেক ছিলেন একজন নামকরা কাপড় ব্যাবসায়ী। মা মেহেরুননিসা ছিলেন গৃহিনী। তিনিও মারা গেছেন ২০১২ সালে। তাদের সাত ভাই বোনের মধ্যে মামুন সবার ছোট। মেজ ভাই আব্দুল মোতালিব জনতা ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন। সেজো ভাই ডা. আব্দুল মান্নান নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার। বড় বোন দিনা জহুরা খাতুন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে চাকরি করতেন। সেজো বোন জিনাত আরা গৃহিণী। তিনি স্বামী সংসার নিয়ে ঢাকার রূপনগরে বসবাস করেন। ছোট বোন ফজিলা আলমও গৃহিনী। তিনিও স্বামী সংসার নিয়ে ঢাকার আরামবাগে বসবাস করেন।
কথা হলো মার্গারিতার ফুপু দিনা জহুরার সঙ্গে। তিনি বলেন, রিতা এ পর্যন্ত তিনবার এসেছে এই গ্রামে। সর্বশেষ এসেছে প্রায় আট বছর আগে। তখন রিতা ছোট ছিলো। সে ভাঙাভাঙা বাংলা বলতে পারে। রিটা আমার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেতো। সব সময় কোলে উঠে জড়িয়ে থাকতে পছন্দ করতো। আদর করতো। বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতো। সুযোগ পেলেই পুকুরের বাঁধানো ঘাটে এসে বসে থাকতো। তার বাবা মামুন মেয়ে রিটাকে বলতো, ‘এটাই তোমার আসল বাড়ি। তুমি এখানে আসবে।’
পুরনো মাটির বাড়ির পাশেই মামুন নির্মাণ করেছেন একতলা ফ্লাট বাড়ি। রাশিয়া থেকে দেশে আসলে এ বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু প্রচন্ড গরম সহ্য করতে পারে না বলে ঘরে লাগানো হয়েছে এসি। কিন্তু সমস্যা হলো খাবার নিয়ে। রিটা এবং তার মা আন্না ভাত-পানি খেতে পারে না। শুধু জুস আর কফি খেতো। লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে চিংড়ি খেতো। মাংসের মধ্যে গরুর জিহবা খেতো লবণ মিশিয়ে সেদ্ধ করে। কোন মসলা তারা খেতে পারতো না। গভীর রাত পর্যন্ত তারা জেগে থাকতো। তাদের সঙ্গে আমাকেও জাগতে হতো। তাদের সঙ্গে রাত না জাগলে ভাবতো আমি তাদের পছন্দ করি না। কিন্তু সন্ধ্যা রাতেই আমার ঘুম পেতো। তবুও তাদের খুশি রাখতে জেগে থাকতাম।’
তিনি বলেন, মামুনের ছেলে ফিলিপ ভালো বাংলা বলতে পারে। মামুন তাকে ভাত খাওয়ানো শিখিয়েছে। রাশিয়ায় বাপ-ছেলে মিলে প্রতি শুক্রবার ভাত সেদ্ধ করে। তারপর তারা একসঙ্গে খায়। ছেলেকে সে বাংলা শিখিয়েছে।
তিনি জানান, মামুন প্রতি বছরই গ্রামে আসতো। এসে ১৫-২০ দিন থাকতো। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনবছর ধরে আর আসতে পারে না। তার একটি কিডনি নষ্ট হওয়ায় তা কেটে ফেলতে হয়েছে। ছয় মাস আগে সে বাথরুমে পড়ে যায়। এরপর আর চলাফেরা করতে পারে না। ক্যান্সারে আক্রান্ত সে। এখন ঠিকমত কথাও বলতে পারে না। মনে হয়না আর কোনদিন সে দেশে ফিরে আসতে পারবে। কখন যে খারাপ খবর শুনতে হয়- বলেই কান্নায় ভেঙেপড়েন দিনা জহুরা।
রিতার ফুপাতো ভাই শামসুজ্জোহা দুর্গাপুরের একটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘রিটা যখন ছোট ছিল তখন তার বাবা চেয়েছিলেন রিটা বাংলাদেশের হয়ে অলিম্পিকে খেলবে। এজন্য তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশের অলিম্পিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন। কিন্তু তারা আগ্রহ দেখাননি। ফলে রাশিয়ার হয়েই তাকে খেলতে হল।’
তিনি বলেন, ‘রিটা আমাদের বাংলাদেশের মেয়ে। এই গ্রামের মেয়ে। আমরা চাই আগামী অলিম্পিক আসরে (জাপানে অনুষ্ঠিত হবে) সে বাংলাদেশের হয়ে খেলুক। এজন্য দেশের পক্ষ থেকে আগ্রহ দেখালে রিতা খেলতে আপত্তি করবে না। কারণ এটা তার বাবার ইচ্ছে ছিল।’
তিনি বলেন, ‘রিটা রাশিয়ার হয়ে খেললেও এ গৌরব আমরা করতেই পারি। কারণ সে আমাদের দেশের মেয়ে।’
রিটার বাড়িতে এখন গ্রামের মানুষের ঢল। নারী-পুরুষ সবাই আসছেন রিটার বাড়িতে। কিন্তু রিটার বাড়িতে তালা ঝুলছে। তাদের প্রাচীর ঘেঁষেই ফুপু দিনা জহুরার বাড়ি। তিনিই সবাইকে সামলাচ্ছেন। দিনার ছেলে শামসুজ্জোহা তার ট্যাবে সবাইকে দেখাচ্ছেন রিটার অপূর্ব ক্রীড়াশৈলী। সবাই বিস্ময়াভিভূত হয়ে তা দেখছে।
আর সবাই বলছেন, ‘দেখ, দেখ আমাদের শিপারের (মামুন) মেয়ে।’ তাদেরই একজন মজিবুর রহমান। পেশায় কৃষক। তিনি বলেন, ‘মেয়ে যখন এসেছিলো তখন ছোট ছিল। এখন এত সুন্দর করে খেলছে। সোনা জিতেছে। এটা আমাদের গৌরব। গাঁয়ের মুখ, দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে সে।’
গৃহবধূ রওশন আরা বলেন, ‘আমরা এতটাই আনন্দিত যে ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে খেলা দেখেছি। চোখ সরাতে পারছিলাম না। ভাবতেই অবাক লাগছিল, এই গ্রামের মেয়ে সারাবিশ্ব জয় করে ফেলেছে।’