‘মাঝে-মাঝে অভিযোগ বা হতাশা আসে’
নিউজ ডেস্ক।। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অপরিহার্য সদস্যে পরিণত হয়েছেন। আঙুলের ইনজুরিতে এই মূহুর্তে ক্রিকেট থেকে দূরে আছেন। তাই সময়টা উপভোগ করতে গিয়েছিলেন তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা জন্মভূমি মাগুরায়। সেখানেই ক্রিকেট ও ক্রিকেটের বাইরে ব্যক্তিগত নানা বিষয় নিয়ে একান্তে কথা বলেছেন বিবিসি বাংলার সঙ্গে। সংক্ষেপিতরুপে একুশে টিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য তা তুলে দেয়া হলো।
সবাই বলে সাকিব অল্পভাষী, অর্ন্তমুখী, সহজে মিশতে পারেন না! এসব প্রঙ্গেই তার সঙ্গে প্রথমে কথা শুরু হয়। তিনি বলতে থাকেন, “আসলে যারা জানেনা তাদের একটা পারসেপশন থাকবেই, তবে আমি কিন্তু প্রচুর আড্ডা দেই। বন্ধুদের সাথে অনেক সময় কাটানো হয়, হয়তো সবার সামনে গিয়ে আড্ডা দেইনা, আমরা আসলে নিজেদের মতো করে সময়-সুযোগ তৈরি করে নিই। আর এই ভক্তদের ব্যাপারটি আমি খুব এনজয় করি। হয়তো অনেকে একসাথে ঘিরে ধরলে বিড়ম্বনা লাগে, এছাড়া এসব আমাকে সবসময় ইন্সপায়ার করে আরো ভালো খেলতে।”
গত ছয় বছরে সাকিবের জীবনে বদল এসেছে অনেক। তার জন্য এখন বছরের শেষভাগটা জীবনের সবচেয়ে গূরুত্বপূর্ণ সময়। তবে নিজের বিবাহবার্ষিকী ১২ই ডিসেম্বরের চেয়ে বেশি অপেক্ষায় থাকেন ৮ই নভেম্বরের জন্য। সেদিন যে তার রাজকন্যার পৃথিবীতে আসার দিন! এসঙ্গে তিনি বলেন, “এটা সবচেয়ে বড় গিফট আল্লাহর তরফ থেকে। আগে অনেকেই বলতো বাবা হওয়াটা অন্যরকম অনুভূতি, আমার বাবাও বলেছে, আমি তখন বুঝতাম না, কিন্তু এখন বুঝি! এটা আসলে এমন একটা ফিলিংস বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ওর কাছে আসলেই আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।“ বাবার গন্ধ পেয়েই বুঝি দোতলার জানালা গলে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাঁকডাক শুরু হয়ে যায় আলাইনা হাসান অব্রির “বাবাই… বাবাই..”।
বাবা নিচ থেকে মুখ তুলে আমাদের সঙ্গে ব্যস্ততার কথা বলেন, কিন্তু মেয়ে কি আর মানতে চায়! অবশেষে দৃশ্যপটে আবির্ভাব অব্রির মা, সাকিবের স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশিরের। আমাদের কথার মোড়ও ঘুরে যায়। পরিবারকে কতটা সময় দেন বাংলাদেশের প্রাণ? তিনি বলেন, “চেষ্টা করি খেলার বাইরে যতোটা সম্ভব সময় দেয়ার। মাঝে মাঝে অভিযোগ বা হতাশা আসে। কিন্তু আমরা দুজনই অ্যাডজাস্ট করি। তবে আমি না থাকলে ও খুব খারাপ ফিল করে, মিস করে, এটা বুঝতে পারি।“
সাকিব প্রসঙ্গ আসলেই উঠে আসে তার সবকিছুতে স্বাভাবিক থাকা ও বাস্তববাদী মানসিকতার কথা। আবেগী বাঙালি চরিত্রের বিপরীতে সাকিবের এটা কি একেবারেই সহজাত নাকি তৈরি করা? সাকিবের ভাষায় এটা তার ভেতরে ছোটবেলা থেকেই, কিন্তু আবিষ্কার হয় বিকেএসপিতে যাবার পরে। “ওখানকার টাফ সিচুয়েশন, ওয়ে অব লিভিং, আমাকে আসলে তৈরি করেছে। দেখেন আমার ব্যাচে ৩০ জনের মতো ছিলাম, তাদের মধ্যে একমাত্র আমি এই জায়গা পর্যন্ত আসতে পেরেছি, সেটা হয়তো আমি বাস্তববাদী বলেই। আর আমি যেরকম মধ্যবিত্ত সাধারণ ঘর থেকে উঠে এসেছি তাতে আসলে এছাড়া আর উপায়ও ছিলনা।“
বিকেএসপির প্রসঙ্গ উঠতেই যেন হুট করে টাইম মেশিন ট্রাভেলে চলে যান ৩১ বছরে পা রাখা সাকিব আল হাসান। কথার দুয়ার খুলে বসেন। “বিকেএসপিতে এত স্মৃতি যে তা দিয়ে রীতিমতো বই লেখা যাবে। শুরুতে প্রথমবার বাসার বাইরে ফ্যামিলি ছেড়ে খানিকটা কঠিন মনে হয়েছে, কিন্তু এরপর নতুন বন্ধু পেয়ে যেতেই সব অসুবিধা দূর হয়ে যায়। আমার লাইফের বেস্ট সময় ছিল এটা।“ আমরা ২০১৮ এর মাগুরা থেকে আরো পেছনে যেতে চাই। টাইম মেশিনটা এবার স্থির করি স্কুলপড়ুয়া হাফপ্যান্ট পরিহিত সাকিবের উপর। স্কুলের বাইরে যে সুযোগ পেলেই কখনো ফুটবলের পেছনে তো আবার কখনো ব্যাট-বলের সাথে ছুটছে, আর শীতের কুয়াশা ভেদ করে প্রায়ই দেখা মেলে ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট হাতে। বাবা মাশরুর রেজা ছিলেন পেশাদার ফুটবলার, ছেলেকেও সেই পথেই তৈরি করছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতলে বদলে যায় দৃশ্যপট।
সাকিব বলেন “আমি আসলে ফুটবলার না ক্রিকেটার হব এমন কোন পরিকল্পনা নিয়ে এগুইনি। মিডল ক্লাস ফ্যামিলির যেমন চিন্তা পড়াশোনা দিয়েই কিছু করা। তবে আমি খেলতে পছন্দ করতাম, সব খেলাই সিরিয়াসলি নিতাম, কখনো হারতে চাইতাম না।” “১৯৯৭ সালের পর ক্রিকেটের হাওয়া লাগে। তখন দেখা যেতো যে শুক্রবার বিকালে সবাই টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখছে, কিন্তু আমি গিয়ে সবাইকে খেলার জন্য ডেকে আনতাম। আমি কিন্তু অনুর্ধ্ব ১৯ দলে খেলা পর্যন্তও ভাবিনি যে কখনো জাতীয় দলে খেলবো বা আমাকে খেলতেই হবে। এমনটা ভাবলে হয়তো ক্রিকেটার হতে পারতাম না, সেটা প্রেশার হয়ে যায়।” “জাতীয় দলে দুই বছর খেলার পর ভাবলাম যে, ঠিক আছে, এটাকে এখন প্রফেশন হিসেবে নেয়া যায়। আমি তো এখন দেখি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কেমন প্রেশার শিক্ষার্থীদের। তারা ধরে নেয়, এটাই হতে হবে। আর এটাই বাড়তি চাপ।”
সাকিব আরো বললেন, “আমি জীবনে কখনো ফিক্সড করিনি কোনকিছু। আমার যে অপশনগুলো ছিল, সবগুলো চেষ্টা করেছি। আমি আলাইনাকেও কোনকিছু চাপিয়ে দিতে চাইনা। শুধু ভালো মানুষ করতে চাই।” ততক্ষণে টাইম মেশিন থেকে বর্তমানে আমরা। নিজের বাড়ির পেছনে বাগানমতো জায়গায় নিয়ে গিয়ে আফসোস করেন সাকিব। “জানেন এখানে এত বাড়ি-ঘর ছিলনা, খোলা মাঠ ছিল। বিদ্যুতের খুটিতে স্টাম্প বানিয়ে খেলতাম। কলা, মুরগী, বাজি রেখে খেলা হত।“
আমরা হাসি আটকাতে পারিনা। সাকিব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে চলেন, “এখানে খেলার প্রভাব কিন্তু এখনো রয়ে গেছে আমার মধ্যে। কারণ ছোটবেলায় যখন খেলতাম তখন হয়তো ওপাশে জোরে মারা যাবে না, বল হারিয়ে যাবে বা ঐ বাড়িতে গেলে বল আর ফেরত পাবো না, তাই অনেক শট খেলতাম না। এ কারণে আমার কিন্তু এখনো কিছু শটে দুর্বলতা আছে। আবার কিছু শট যে ভালো খেলি, সেটাও এখানে খেলার কারণেই।” কি, সাকিবের গল্পের সাথে নিজের শৈশবের মিল খুঁজে পাচ্ছেন? সাকিবের আতিথেয়তায় মধ্যাহ্নভোজ শেষে আমরা বেরিয়ে পড়ি তাঁর শহর মাগুরা আবিষ্কারে।
প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া তার মডেল স্কুল মাঠে গিয়ে দেখা মেলে পরবর্তী প্রজন্মের সাকিব হবার চেষ্টা। সাকিবের অন্যতম প্রিয় শিক্ষক শফিকুল ইসলামও বলছিলেন এই শিশু কিশোররা কিভাবে তাকে আইডল মেনে বড় হচ্ছে।
আমরা দেখতে যাই, যেই মাঠ সাকিব আল হাসানকে তৈরি করেছে সেই মাগুরা জেলা স্টেডিয়াম। সেখানেও তাকে নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি। সাকিবের প্রথম কোচ সৈয়দ সাদ্দাম হোসেন গোর্কি বলছিলেন এখানে সাকিবের প্রথম অনুশীলনে আসা, পেস বল করা, তারপর স্পিনার হয়ে ওঠার গল্প। “আমি যখন বললাম তুমি স্পিন বল কর, তখন ঐটুকু বয়সে ও আমাকে প্রশ্ন করলো আমি কেন পেস না করে স্পিন করবো?”
“আমি অবাক হয়ে তাকে বললাম – কারণ তোমার বাঁহাত ছোট, পেসাররা টল ফিগার হয়। ও পরদিন থেকে স্পিন করা শুরু করে এবং ওকে কিছু শেখানোর আগেই আমি দেখলাম তার সহজাত প্রতিভা আছে।“ সাকিবও বলছিলেন এই মাঠে তার প্রথম আনুষ্ঠানিক ক্রিকেট ম্যাচের কথা, ১ বলে ১ রানে নট আউট আর প্রথম বলেই উইকেট পাওয়ার কথা তিনি ভুলতে পারবেন না কখনোই। সাকিবের ছেলেবেলা সম্পর্কে জন্মদাত্রী শিরিন রেজা বলেন, “ওর হাতে সারাক্ষণ বল থাকতো। আমি খাওয়াতাম, ও বল দেয়ালে ছুড়ে মারতো, পড়ার সময়ও হাতে বল। এমনিতে খুব শান্ত, কিন্তু খেলার সময় দুরন্তপনার শেষ থাকতো না। ওর বাবা অনেক বকাবকি করেছে।
“একদিন তো পরীক্ষার আগে ও খেলতে চলে গেছে। এরপর যখন আসছে আমি রাগ করে ব্যাট কেটে ফেলি। ও মন খারাপ করে পরীক্ষা দিতে চলে যায়। এরপর এসে শুধু বলে তুমি ব্যাট না কেটে আমাকে মারতা।” কিভাবে তিনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন? সাকিব বলেন, ‘আমি কোন পার্সোনাল টার্গেট সেট করি না, দেশের জন্য অবদান রাখতে চাই, কখনো ভাবিনি আমাকে নাম্বার ওয়ান হতে হবে, শুধু ভালো খেলতে চেয়েছি, বাকি অর্জন সব অটোমেটিক হয়ে গেছে।’ উৎস: একুশে টেলিভিশন।