ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বের রোল মডেল বাংলাদেশ
নিউজ ডেস্ক : মা ইলিশ রক্ষায় চলছে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা। এ নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছিল ৭ অক্টোবর, শেষ হবে ২৮ অক্টোবর। ২৯ অক্টোবর থেকে দেশের সব নদ-নদীতে পুরোদমে চলবে ইলিশ আহরণ, বিতরণ ও বিপণন। দেশের ৩৭টি জেলার প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার নদীতে স্বাচ্ছন্দ্যে ইলিশের ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতেই এ নিষেধাজ্ঞা চলছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ইলিশ মাছ। বাংলাদেশের (মোট দেশজ উৎপাদন) জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক দশমিক ১৫ শতাংশ। এদেশের মোট মাছের ১২ শতাংশ অবদান রাখছে ইলিশ। ওয়ার্ল্ড ফিসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে মোট ইলিশের ৬০ শতাংশই বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া, ভারতে ২০ শতাংশ, মিয়ানমারে ১৫ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে বাকি ৫ শতাংশ ইলিশ মাছ ধরা পড়ে।
সূত্র আরও জানায়, বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। এসব দেশের উপকূলেও ইলিশ ধরা পড়ে। তবে শুধুমাত্র বাংলাদেশে প্রতিবছর ৯-১০ শতাংশ হারে ইলিশ উৎপাদন বাড়লেও ওই ১০টি দেশেই উৎপাদন কমেছে।
কারণ হিসেবে জানা গেছে, ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য বেছে নেয় বাংলাদেশকে। এজন্য বর্ষায় এদেশের নদীগুলো ‘মা’ ইলিশে ভরে ওঠে। মোহনা থেকে নদীর ১২০০ থেকে ১৩০০ কিলোমিটার উজানে ও উপকূল থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত সমুদ্রে ইলিশ পাওয়া যায়। দিনে ৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ইলিশের। সাগর থেকে ইলিশ যত ভেতরের দিকে আসে, ততই শরীর থেকে লবণ কমে যায়। এতে ইলিশের স্বাদ বেড়ে যায়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছরই বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। মাত্র দেড় দশকের ব্যবধানে এসংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে দুই লাখ টনের ওপরে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮৬-৮৭ সালে দেশে ইলিশ উৎপাদন হতো ১ লাখ ৯৫ হাজার টন। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৯১ হাজার টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার টনে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। আর বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা থেকে শুরু করে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওরেও এবছর ইলিশ পাওয়া গেছে।
তবে জাটকা নিধনের কারণে ইলিশ মাছের সংখ্যা আরও ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট ইলিশকে জাটকা বলা হয়। ২০১২ সালে দেশে ১০ হাজার ৯০০ টন, ২০১৩ সালে সাড়ে ১১ হাজার টন, ২০১৪ সালে ১১ হাজার ৮০০ টন জাটকা ধরা হয়। এগুলোর আকার ১৪-২০ সেন্টিমিটারের মধ্যে। আর ওজন গড়ে ৩০ গ্রাম। হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ৩৮ কোটি জাটকা ইলিশ ধরা পড়ছে দেশে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বছরে যে পরিমাণ জাটকা ধরা হয়, তার অর্ধেকও যদি রক্ষা করে সেগুলোর গড় ওজন ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত নেওয়া যেত, তাহলে দেশে ইলিশের উৎপাদন আরও ৫০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় দুই লাখ টন বাড়ানো সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সরকারি নজরদারি। তাদের আশা, প্রজনন মৌসুমে সর্বোচ্চসংখ্যক ইলিশ যেন ডিম ছাড়তে পারে ও ছোট ইলিশ যেন বড় হতে পারে, সেজন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এটা করা গেলে দেশের ছোট-বড় নদীগুলো আবারও ভরে উঠবে ইলিশে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, একটি ইলিশ একসঙ্গে কমপক্ষে ৩ লাখ ও সর্বোচ্চ ২১ লাখ ডিম ছাড়ে। এসব ডিমের ৭০-৮০ শতাংশ ফুটে রেণু ইলিশ হয়। এর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে এবং তা ইলিশে রূপান্তরিত হয়।
গবেষণা থেকে জানা যায়, মানুষের দেহের রক্তের কোলস্টেরল ও ইনসুলিনের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগ উপশম করে ইলিশে থাকা ওমগো থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। এছাড়া, ইলিশে আছে প্রচুর পরিমাণের ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ। এ মাছের তেলে রয়েছে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরু থেকে কার্তিক মাসের শেষ পর্যন্ত সময়কে ইলিশ ধরার মৌসুম বলা হয়। তবে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস ইলিশের ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচিত।
এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইলিশের ওপর নির্ভরশীল। এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জানান, উপকূলীয় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি সম্পৃক্ত। এছাড়া, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আরও ২০-২৫ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ইলিশ। তারা পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রফতানি ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে। বাংলা ট্রিবিউন