বিচিত্র উপাধিতে ম্লান নামের মহিমা
হাকিম মুহাম্মদ কালিমুল্লাহ: আজকাল আমরা আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে লজ্জা বোধ করি না। বরং সৃষ্ট জীবকে লজ্জা বোধ করি। অন্যদিকে ইসলামী শরিয়ত আমাদের ওপর এতই দয়া করেছে, যেটা তুলনাহীন। কিছু সময় ইসলামী শরিয়ত মাখলুককে লজ্জা বোধ করার অনুমতি দিয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা মাখলুককে লজ্জা বোধ করো, যাতে কেউ তোমার ওপর আঙুল উঠাতে না পারে, তোমার ওপর বদনাম না করে। চাই মানুষ অনেক নিম্নমানের হোক—শরিয়ত তাকে অপদস্থ করতে চায় না। আর অপদস্থ হওয়া মুমিনের শান নয়। কারণ মুমিন আল্লাহ তাআলার অতি নিকটবর্তী হয়। এ জন্য তাকে অপদস্থ মনে করাটাও উচিত নয়। তার কারণ হলো, কাউকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখা কবিরা গুনাহ। কিছু লোক অন্য কিছু লোককে অবজ্ঞার সঙ্গে এটা বলে যে সে তো অমুকের ছেলে এবং তার সম্পর্ক অমুক বংশের সঙ্গে। এমন ব্যক্তি দুই ধরনের গুনাহর মধ্যে লিপ্ত হয়। প্রথমত, অন্যকে তাচ্ছিল্যের সুরে ডাকা, আর দ্বিতীয়ত, নিজেকে তার থেকে উত্তম মনে করা—অর্থাৎ সে অহংকারের মধ্যে লিপ্ত হয়ে গেল। এমনিভাবে কোনো ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা ইলমের দৌলত দিয়েছেন, কোরআনে পাক ও হাদিসে নববীর দৌলত দ্বারা সুসজ্জিত করেছেন এবং সে আলেম হয়ে গেল। যে ব্যক্তির সঙ্গে আল্লাহ তাআলা এমন অনুগ্রহের আচরণ করলেন, তখন ওই ব্যক্তি অন্যকে এই বলে যে আরে মিয়া সে কী জানে, সে তো মূর্খ! এমন ব্যক্তিও দুই ধরনের কবিরা গুনাহর মধ্যে লিপ্ত হয়ে গেল। প্রথমত, সে নিজেকে আলেম মনে করে তার বড়ত্বকে দেখাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, গুনাহে কবিরা হলো এই যে সে অন্যকে তুচ্ছ মনে করল। আজকাল এই রোগ ব্যাপক। তাই এমন ব্যক্তির খুব তাড়াতাড়ি তাওবা করা উচিত।
আজ আমাদের মধ্যে মতবিরোধ বাড়ার একটা কারণ এটাও যে আমরা চাই অন্যরা আমাদের অনুসরণ করুক এবং আমার কথাগুলো সমর্পণ করুক। আমার কাছে এক ব্যক্তি এসেছিল। মাশাআল্লাহ, ওই ব্যক্তি আলেমও ছিল। যখন তারা একজন অপরজনের সঙ্গে পরিচয় আদান-প্রদান করল, তখন সে তার নামের সঙ্গে ‘কাসেমি’ যোগ করে দিল (ভারতের দেওবন্দ মাদরাসায় যারা পড়ালেখা করে, তাদের ‘কাসেমি’ বলা হয়)। আমি ওই সময় চেম্বারে ছিলাম এবং প্রেসক্রিপশন লিখছিলাম। যখন তারা এ কাজ করল, তখন আমি আমার কলম রেখে দিলাম। অতঃপর আমি তাদের দিকে মনোনিবেশ করলাম। আমি বললাম, এভাবে নিজের নামের সঙ্গে উপাধি লাগানোর দ্বারা আপনার মধ্যে অহংকারের ভাব চলে আসবে। আপনি আপনার সঙ্গে উপাধি লাগিয়ে এ ভাব প্রকাশ করছেন যে আমি আলেম, অমুক প্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা সমাপ্ত করেছি। এ জন্য আপনি আমায় সম্মান করুন। এ কথা আপনার গোপন রাখা দরকার ছিল। কেননা আমাদের আকাবির নিজের নামের সঙ্গে উপাধি লাগানো কখনো পছন্দ করতেন না। মাওলানা থানভি (রহ.) ‘কাসেমি’ ছিলেন। কিন্তু কখনো নিজের নামের সঙ্গে কাসেমি লাগাননি। এমনিভাবে শাহ অসিউল্লাহ (রহ.)ও ‘কাসেমি’ ছিলেন এবং শাহজালাল আবাদি (রহ.)ও ‘কাসেমি’ ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কখনো নিজের নামের সঙ্গে ‘কাসেমি’ লাগাননি। যত আকাবির অতিবাহিত হয়ে গেছে, যেমন—মাওলানা আসাদুল্লাহ (রহ.), শায়খ জাকারিয়া (রহ.) প্রমুখ কেউ কখনো প্রকাশ করতেন না যে আমি আলেম। বাস্তবে এই হজরত শুধু আলেম ছিলেন না; বরং আল্লামা ও ইলমের সাগর ছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিনয়ের কারণে তাঁদের নাম দুনিয়ার মধ্যে দীপ্তিমান হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা ওই সব লোককে কতই না আলোকিত করেছেন, যা কারো কাছে গোপনীয় নয়।
এখন ঘরে ঘরে ‘আল্লামা’, ‘শায়খুল হাদিস’ আর ‘মুফতি’র ছড়াছড়ি। অথচ আগের মুসলিম মনীষীদের এসব উপাধি ধারণ করার নজির মেলে না। এগুলো অহংকারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কী?
উর্দু থেকে ভাষান্তর : মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ