টাকা দিতে সহকর্মীদের বাধ্য করেন এএসপি!
ডেস্ক রিপোর্ট : সহকর্মীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, তাঁদের কাছ থেকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে টাকা আদায়, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে দিতে বাধ্য করার মতো গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে গাজীপুরের একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এই কর্মকর্তা হলেন কালিয়াকৈর সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) শাহিদুল ইসলাম।
সার্কেলের অধীন দুটি থানায় কর্মরত অন্তত ৩০ জন পুলিশ সদস্য এএসপি শাহিদুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগ তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়া গেছে। এসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গত ২০ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তরে এসেছে। এ বিষয়ে আরো তদন্ত চলছে বলে সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
তবে এএসপি শাহিদুল ইসলাম বলেছেন, একটি মামলায় আসামির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন না দেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে।
উল্লেখ্য, শাহিদুল ইসলাম গাজীপুরে যোগ দেন গত বছরের ২৬ এপ্রিল।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শাহিদুল ইসলামের অনিয়ম ও অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের কারণে শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর থানার পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। বিষয়টি অনুসন্ধান করার জন্য গাজীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদের নির্দেশে গত ১৭ আগস্ট তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
কমিটির সদস্যরা হলেন গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) গোলাম সবুর, সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফাজ্জল হোসেন ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস শাখার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার ডা. নন্দিতা মালাকার। তদন্ত কমিটি দুটি থানার পুলিশ সদস্য ও এএসপি শাহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে।
কমিটি নিশ্চিত হয় যে শাহিদুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। উপপরিদর্শকদের (এসআই) কাছ থেকে প্রতি মাসে চার-পাঁচ হাজার ও সহকারী উপরিদর্শকদের (এএসআই) কাছ থেকে তিন হাজার টাকা করে আদায় করেন। টাকা দিতে অপারগতা জানালে তাঁদের বদলি করে দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেন তিনি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেকোনো মুহূর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উদ্ভব হতে পারে। এএসপি শাহিদুল ইসলামের অপেশাদার আচরণ ও কার্যকলাপ বিভাগীয় নিয়ম-শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এ অবস্থায় শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর থানার কর্মকর্তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে তাঁকে অন্যত্র বদলি করাসহ বিভাগীয় প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম সবুর কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা যথাসময়ে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন এসপি হারুন অর রশীদের কাছে জমা দিয়েছেন।
জানা গেছে, প্রতিবেদনটি গত ২০ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের (অ্যাডিশনাল আইজিপি-প্রশাসন) কাছে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়।
গাজীপুর জেলা পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটির ওই প্রতিবেদনে কালিয়াকৈর ও শ্রীপুর থানার বেশ কয়েকজন সদস্যের জবানবন্দি উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) হেলাল উদ্দিন, কালিয়াকৈর থানার ওসি রফিকুল ইসলাম, শ্রীপুর থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান, জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি-উত্তর) ওসি আমির হোসেন, কালিয়াকৈর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ মাসুদ আলম ও পরিদর্শক (অপারেশন) সানোয়ার হোসেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন কমিটিকে বলেছেন, এখানে যোগদানের পর থেকে শাহিদুল ইসলাম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ এবং থানার এসআই ও এএসআইদের অহেতুক গালমন্দ করে আসছিলেন। সব এসআইয়ের কাছ থেকে প্রতি মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা এবং এএসআইদের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা করে নিয়ে দিতে বলা হয় তাঁকে। কেউ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।
পুলিশ পরিদর্শক হেলাল তদন্ত কমিটিকে আরো বলেছেন, নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দেওয়ার পাশাপাশি এএসপি শাহিদুল গ্রামের বাড়িতে রাস্তা, মসজিদ ও স্কুল মেরামতের কথা বলেও টাকা নেন। এ জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে দিতে হয়। এলাকার ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেও চাঁদা তুলে দিতে হয় তাঁকে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে তাঁকে প্রাইভেট কার পর্যন্ত কিনে দিতে বলেছেন।
কালিয়াকৈর থানার পরিদর্শক সানোয়ার জাহান তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, ‘শাহিদুল স্যার থানায় এসে অফিসারদের সঙ্গে মামলা নিয়ে কথা বলতেন। তিনি বলতেন পুলিশ সুপার বদলি হলে চাকরি কিভাবে করতে হয় সেটা দেখবেন।’
এসআই সৈয়দ আজিজুল হক বলেছেন, চলতি বছরের ৪ আগস্ট শাহিদুল ইসলাম তাঁর কার্যালয়ে জনৈক বেলাল ফকিরের সামনে অহেতুক তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। এমনকি দাপট দেখিয়ে বলেন, এসপি চলে যাওয়ার পরের দিন তাঁকে জেলাছাড়া করবেন।
অভিযোগকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। যোগাযোগ করা হলে জয়দেবপুর থানার ওসি আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি জবানবন্দি নেওয়ার সময় আমি শ্রীপুর থানায় কর্মরত ছিলাম। জবানবন্দিতে যা উল্লেখ ছিল তা-ই সত্য।’
এএসপি শাহিদুল ইসলাম তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, তিনি কোনো অনৈতিক কাজে জড়িত ছিলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন, যুক্তিহীন, ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
জানতে চাইলে শাহিদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শ্রীপুরের স্থানীয় একজন সাংবাদিক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে কটূক্তি করায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। আমি তাতে রাজি না হওয়ায় আমার বিরুদ্ধে ওই সব প্রপাগান্ডা চালানো হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘এসপি স্যার চলে যাওয়ার পর আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছিল তাদের মধ্যে অনেকেই পুনরায় লিখিতভাবে বলেছে, চাকরির ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছিল। আমরা যে লিখিত দিয়েছিলাম তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।’
গাজীপুরের সাবেক এসপি হারুন অর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গাজীপুর জেলা পুলিশের একটি তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশ সদর দপ্তরে এসেছে। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ উৎস : কালের কন্ঠ