বাগেরহাটে বিলুপ্তির পথে ৪৯ প্রজাতির মাছ
বাগেরহাট প্রতিনিধি : বাগেরহাটে ৪৯ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। বাজারগুলো বিদেশি কার্প জাতীয় মাছের দখলে। নদীতে পানি না থাকায় আর খাল-বিল লিজ দেওয়ায় জেলার মৎস্যজীবীদের অনেকে বদলে ফেলেছেন তাদের পেশা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বাগেরহাটের ছোট-বড় ২১টি নদী বিলীন হয়ে গেছে। এসব নদীর ভেতর এখন নির্মিত হয়েছে পাকা ঘরবাড়ি ও রাস্তা। এছাড়া অন্যান্য অনেক নদীও নাব্যতা হারিয়ে এখন মরা খালে রুপ নিয়েছে। শুধু রামপালের ঘষিয়াখালী চ্যানেল সংলগ্ন ৮৩ খালে অবৈধ বাঁধ দিয়ে দখলবাজরা খালগুলো দখলের চেষ্টা করছে। অবশ্য এ বছর এই খালগুলো পুনঃখননের জন্য অর্থ বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে।
মৎস্য ঘের ও কৃষি জমিতে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার বিশেষ করে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বদ্ধ মাছের ঘেরে ব্যবহৃত সার ও কীটনাশক গোলানো পানি সংশ্লিষ্ট এলাকার নদী-খালে ছড়িয়ে পড়ায় উপকূলজুড়ে মৎস্য শাবকদের নার্সারি গ্রাউন্ড কসাইখানায় পরিণত হয়েছে। পাশাপশি পুরো দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে নদ-নদীতে বছরের বেশিরভাগ সময় কারেন্ট জাল দিয়ে চিংড়ি রেনু আহরণকালে অন্যান্য প্রজাতির মাছের পোনা নির্বিচারে নিধন হচ্ছে।
এদিকে সুন্দরবনের নদী-খালে নির্বিচারে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের কারণে সমূলে বিনাশ হচ্ছে মাছের বিভিন্ন প্রজাতি। সুন্দরবনের জেলেদের সূত্রে জানা গেছে, জোয়ারের সময় খালের মুখে নিচু করে জাল পেতে রাখা হয়। ভাটার সময় হলেই জালটি উঁচু করে খালের মুখে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়। ফলে ওই খালের ভেতর থাকা ছোট-বড় সব মাছ মারা যায়। এভাবেই বিলুপ্তির পথে এগুচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
সূত্রমতে, স্বাদু পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলে ৪৯ প্রজাতির মাছ এখন আর এ অঞ্চলের নদী খালে তেমন পাওয়া যায় না। এসব মাছের মধ্যে সরপুঁটি, রয়না, বাটা, দারকিনা, পাবদা, বোয়াল, গজাল, গড়োই টাকি, নাপিত কই, তিতপুঁটি, ডগরী, চান্দা, চুচড়া, গুলশা টেংরা, চিতল, তারা বাইন, আইড়, ভাঙ্গান, মলা, খলিশা, মৌরে চ্যালা, মাগুর, টাড়ো ভাঙ্গান, বাঁশপাতা, শিং, গোদা চিংড়ি ও নুন্দি বালে বিপন্ন তালিকার মধ্যে অন্যতম।
বাগেরহাট উপকূলীয় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি শেখ ইদ্রিস আলী জানান, অপরিকল্পিতভাবে মাছ শিকার ও মাছের প্রজনন সময়ে নেট দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। এগুলো দেখার কেউ নেই। এমনকি সংশ্লিষ্ট বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারাও তাদের সহযোগিতা করে। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে মাছের আড়ত গড়ে ওঠায় নির্বিচারে মাছ ধ্বংস হচ্ছে। যার পরিসংখ্যান খোদ মৎস্য বিভাগের কাছেও নেই।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, দেশীয় মাছ যত্রতত্র ডিম ছেড়ে বংশ বিস্তারের মাধ্যমে বড় হয়। কিন্তু গ্রামের গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষরা শুষ্ক মৌসুমে সামান্য পানি থাকা ডোবাগুলো সেচে সব মাছ নির্বিচারে ধরার ফলে মাছের বংশ বিস্তারে চরম বিঘœ ঘটে। আবার ফসলী জমিতে প্রচুর কীটনাশক প্রয়োগ করায় পানি দূষিত হয়ে মাছের মৃত্যু, রোগবালাই বৃদ্ধি এবং প্রজনন ক্ষমতা নষ্টের ফলে পরবর্তী বছরে পর্যায়ক্রমে দেশীয় মাছ আর পাওয়া যায় না।
বাগেরহাট মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট পুকুর আছে ৩৪ হাজার ৫শ ৬৫টি, যার মোট আয়তন ৪ হাজার ৯ শ ৫০ হেক্টর, খাস পুকুর ৬শ ১৭টি, আয়তন ৬শ ৫৬ হেক্টর, খাল রয়েছে ৫শ ৪৭টি, আয়তন ৮শ ৮৫ হেক্টর, বীল ২২টি, আয়তন ৪হাজার ২শ ৩২ হেক্টর। মাছের উৎপাদন গলদা চিংড়ি ১৬ হাজার ৪শ ১ মেট্রিক টন, বাগদা ১৬ হাজার, ৪ শ মেট্রিক টন, সাদা মাছ ১১ হাজার ৮শ ৮০ মে.টন, মাছের চাহিদা ২৯ হাজার ৫শ মেট্রিক টন। জেলায় মৎস্যজীবী রয়েছেন ৪০ হাজার ৫শ জন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিয়া হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘দেশীয় মাছ রক্ষার জন্য ইতোমধ্যে নানা ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। চাষের মাধ্যমে এই বিলুপ্ত প্রায় মাছের জাতগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাছাড়া অভয়াশ্রামের মাধ্যমেও বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে। এ বছর বাগেরহাট জেলায় ছয়টি অভয়াশ্রাম তৈরি করা হয়েছে। সারা বছর এখান থেকে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ।’ বাংলাট্রিবিউন