শুক্রবার, ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ইং ১৩ই আশ্বিন, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিদেশীরা তৎপরতা শুরু করেছে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে পরিবেশ সৃষ্টির চাপও দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ সীমিত থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট বারশিনস্কি বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের উদ্বেগ অত্যন্ত স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে আগ্রহী। আমরা সব রাজনৈতিক দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দেখতে চাই। এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ দেখতে চাই, যাতে সবার কণ্ঠ শোনা যাবে। গণতন্ত্র সবচেয়ে শক্তিশালী হবে এবং জনগণ তাদের মতামত অবাধে জানাতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সবাইকে সুযোগ দিতে হবে।’

মঙ্গলবার ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমাদের বার্তা হল, যদি শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক দল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে চায়, তবে তাদের তা করতে দেয়া উচিত। এতে করে ওইসব রাজনৈতিক দলের সদস্যরা কোনো প্রকার ভয়-ভীতি ছাড়াই তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে। মার্চে যখন আমি এখানে এসেছিলাম, তখনও আমি সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছে একথা বলেছি।’ আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে।

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে বারশিনস্কি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এমন হওয়া উচিত যার মাধ্যমে বৃহত্তর রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি ও মতামতের প্রতিফলনের সুযোগ থাকে। নির্বাচনের সময়টায় সে সুযোগ বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকবে বলে আমি আশা করি।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ এ কারণে যে, এ দেশ শক্তিশালী গণতান্ত্রিক মূলবোধে বিশ্বাসী। এখানে রয়েছে বহু মত ও পথের এবং সহনশীল সমাজ। এসব মূল্যবোধ বাংলাদেশকে আগামী দিনে স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হবে’।

মার্কিন এ উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট বারশিনস্কি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিরাপত্তা সংলাপে যোগ দিতে ঢাকায় আসেন ১ অক্টোবর। চার দিনের সফর শেষে আজ বিকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রমবিষয় দেখাশোনা করেন। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, আইন মন্ত্রণালয় এবং শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রবার্ট বারশিনস্কি মার্চ মাসেও একবার বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। নভেম্বরের মাঝামাঝি ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসবে বলেও জানা গেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। ফলে নির্ধারিত সময়সূচি মোতাবেক ২০১৯ সালে বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এ অবস্থায় আগাম নির্বাচন সম্পর্কে মার্কিন এ উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

ইতিপূর্বে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্বে বিদেশীরা বিভিন্ন মতামত দিয়েছিলেন। বিশেষ করে সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা পশ্চিমা দেশগুলো বলেছিল। কিন্তু তাদের ওইসব বক্তব্যের প্রতিফলন নির্বাচনে ঘটেনি। একতরফা নির্বাচন হয়ে যায়। তখন প্রতিবেশী ভারতসহ কোনো কোনো দেশ ওই নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বলে সমর্থন করেছিল। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভক্তি বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে জটিল করেছিল কিনা জানতে চাইলে বারশিনস্কি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পরিস্থিতিকে জটিল করেছে এটা বলা যায় না। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের পরিস্থিতিটাই ছিল জটিল। তাছাড়া বিভিন্ন পক্ষ বিভিন্ন ধরনের মতামত দেবে তাতে আমি বিস্মিত হই না।’

বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত প্রয়োজন
মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট বারশিনস্কি বাংলাদেশে ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এসব ক্ষেত্রে দোষীদের বিচার হওয়া প্রয়োজন।’ সন্ত্রাস দমন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটা গোটা বিশ্বেরই একটি সমস্যা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আমরা দেখেছি, গোটা ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে হামলা হয়েছে। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশই এ সমস্যা মোকাবেলা করছে। আমরা সবাই একে অন্যের কাছ থেকে শিখছি। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার করার মতো অনেক কিছু আছে। অন্যান্য দেশেরও শেয়ার করার মতো অনেক কিছু আছে। এ কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে সংলাপ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের কাছ থেকেও আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। আমরা সবাই স্থানীয় সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড দেখছি, যা তারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের কাছে থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে শিখেছে।’

জঙ্গি দমনের উপায় সম্পর্কে মার্কিন এ উপসহকারী মন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশ ও অপরাপর নিরাপত্তা বাহিনীর জনগণের নিবিড় সহযোগিতা নিয়ে উগ্রবাদীদের দমনের সবচেয়ে ভালো উপায়। যেখানেই হামলা হয়েছে, সেখানে জনগণের কাছ থেকেই পুলিশ সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে তথ্য পেয়ে থাকে। পুলিশকে ভয় করলে তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশে কথিত ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অভিযোগ তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। সেখানে আইনের কোনো অপব্যবহার হয়ে থাকলে অপরাধী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা প্রয়োজন। মানবাধিকার লংঘন মোকাবেলা করার ব্যাপারে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা হতাহত হওয়ায় নিরাপত্তা সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আন্তরিক শোক প্রকাশ করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস দমনে বাংদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে চায়। বিশেষ করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট গঠনে আমরা বেশ সহায়তা করেছি। আমরা পুরোপুরিভাবে অনুধাবন করতে পারি যে, পুলিশিং খুবই বিপজ্জনক এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত হলেও তার ফলাফল এটা (সন্ত্রাসীকে মেরে ফেলা) হতে পারে না। আইনগতভাবেই হোক আর আইনবহির্ভূতভাবেই হোক অপরাধীদের মেরে ফেললে গোয়েন্দা তথ্য অজানা থেকে যাবে। বরং অপরাধীদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এতে করে সন্ত্রাসীদের অপর সদস্যদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।’

শ্রমিক ইউনিয়নের ৬০ শতাংশ আবেদন গৃহীত হয়নি
শ্রম পরিস্থিতি সম্পর্কে উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের পর বেশকিছু নিরাপত্তা ইস্যুর ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। তবে শ্রমিকের অধিকারের বিষয়ে বিশেষ করে শ্রমিক ইউনিয়ন ইস্যুতে তেমন অগ্রগতি হয়নি। আমরা দেখতে পেয়েছি যে, ট্রেড ইউনিয়ন অনেকে নিবন্ধন করতে পারেননি। শ্রমিক ইউনিয়ন করার জন্য ৬০ শতাংশ আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য আমাদের বার্তা হল, শ্রমিকের সংগঠিত হওয়ার অধিকারের ব্যাপারে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে। এটা শুধু তৈরি পোশাক কারখানাতেই নয়; বরং অপরাপর কারখানার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।’