১২ বছরেই বুড়ি হয়ে যাওয়া সেই নিতুকে নিয়ে প্রতারণা
বিরল রোগ প্রজেরিয়া আক্রান্ত শিশু নিতুকে (১২) নিয়ে প্রতারণা করার অভিযোগ উঠেছে। শিশুটির বাবা রোববার (২১ অক্টোবর) এ বিষয়ে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি এ প্রতারণা রোধ করতে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন।শহরের শায়েস্তানগর এলাকার বাসিন্দা কামরুল হাসান ও জ্যোৎস্না বেগমের মেয়ে তাকলিমা জাহান ওরফে নিতু ২০০৬ সালে জন্মগ্রহণ করে। শিশুটির জন্মের পর থেকেই তাঁর শারীরিক গঠনপ্রণালী ছিল অন্যান্য শিশুদের থেকে আলাদা।
আর্থিকভাবে অসহায় এ পরিবারের পক্ষে তাঁর চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যগত অবনতি হলে ২০১৩ সালে নিতুকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।সেখানে পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা নিশ্চিত হন নিতু প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রজেরিয়া অর্থ ‘অল্পতেই বৃদ্ধ’। এ রোগ হলে শরীর বৃদ্ধি দ্রুতগতিতে হতে থাকে। শুরু হয় সাধারনত শিশু বয়সে। যার ফলে শিশুটি ছোটবেলা থেকেই শারীরিকভাবে বড় হতে থাকে একজন বৃদ্ধের চেহারায়।
নিতুকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ ফেসবুকে লেখালেখি হলে অনেকই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেও বিরল রোগ প্রজেরিয়া চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না নিতুর পরিবারের।এদিকে, জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি চৌধুরী জান্নাত রাখি নামে এক নারী নিতুর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর স্বামী হবিগঞ্জের বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে অন্যত্র বদলি) এ সুবাধে তিনি হবিগঞ্জে বসবাস করেন। তিনি প্রায় সময়ই নিতুদের বাসায় আসা যাওয়া করতেন। নিতুকে নতুন কাপড়-চোপড় কিনে দেওয়াসহ নিতুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন জান্নাত।
একদিন চৌধুরী জান্নাত নিতুর মা-বাবা জানান, নিতুকে নিয়ে তাঁদের আর চিন্তা নেই। এখন থেকে তাঁর সমস্ত দায়দায়িত্ব তিনি নিবেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক অনুদান এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এ কথা শুনে অনেকটা নির্ভার হন নিতুর পরিবার।জান্নাত রাখি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে তাঁর আইডিতে নিতুকে নিয়ে অসংখ্য ছবি প্রকাশ করেন। ছবিসহ স্ট্যাটাসগুলোতে তিনি দাবি করেন নিতু তাঁর মেয়ে। এখন থেকে তাকে লালন-পালনের সব দায়িত্ব তাঁর। হবিগঞ্জসহ দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে তার এ মহানবতার কথা।
সম্প্রতি নিতুর ভাই নিশান আহমেদ, চৌধুরী জান্নাত রাখির ফেসবুক আইডিতে একটি স্ট্যাটাসে দেখতে পান। তাতে তিনি লিখেছেন নিতুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাঁচ লাখ টাকা সংগ্রহ করে তিনি নিতুর পরিবারকে দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি এ কথা দিয়ে একটি ভিডিও ক্লিপও দেন তাঁর ফেসবুক আইডিতে।এদিকে নিতুর পরিবার বিস্মিত জান্নাতের এ ফেসবুক স্ট্যাটাস ও ভিডিও ক্লিপ দেখে। তাঁদের ধারণা জান্নাত নিতুর নাম ভাঙ্গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে টাকা উত্তোলন করেছেন। তাঁরা ফেসবুকের কপিসহ হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কাছে গত রোববার একটি অভিযোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি এর আগে তাঁরা একই বিষয়ে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
অভিযোগে বলা হয়, নিতুর পরিবার সরকারি কোনো অনুদান পায়নি। চৌধুরী জান্নাত রাখি নিতুর মা সেজে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া জান্নাত রাখি নানা সময় লোকজনের কাছে বলে বেড়াচ্ছেন নিতুর ভরণ পোষণে ব্যর্থ হয়ে তাঁর মা-বাবা নিতুকে জান্নাতের কাছে দত্তক দিয়েছেন।নিতু এখনও তাঁদের পরিবারের সঙ্গেই আছে। জান্নাতের দাবি সঠিক নয়। চৌধুরী জান্নাত রাখি সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ উঠিয়ে আত্মসাৎ করছেন। এ বিষয়গুলো তিনি তদন্ত চান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানান।
নিতু মা জ্যোৎস্না বেগম বলেন, কখনো ভাবিনি এ মহিলা নিতুকে ব্যবহার করে এভাবে ফায়দা লুটবে। সে বিভিন্ন জায়গায় ছড়াচ্ছে আমরা নিতুকে দত্তক হিসেবে তাকে দিয়ে দিয়েছি। মানুষ গরিব হলে কী নিজের সন্তানকে ফেলে দেয়। তিনি আরো বলেন, জান্নাত সম্প্রতি হবিগঞ্জ সমাজসেবা কার্যালয় থেকে নিতুর নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা তুলেছেন। বিষয়টি সমাজসেবা অফিসের এক কর্মকর্তা তাকে নিশ্চিত করেন।বাবা কামরুল হাসান বলেন, চৌধুরী জান্নাত তাঁর মেয়ের ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে প্রতারণামূলক নানা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি মানুষ মানুষের জন্য নাম দিয়ে একটি পোস্টার তৈরি করেন জান্নাত।
তাতে তিনি নিজের ছবির সঙ্গে তার মেয়ে নিতুকে ব্যবহার করেছেন। এমনভাবে পোস্টারের নকশা করেছেন যেন নিতু মা তিনি। এ ভাবে তিনি সামাজিক কর্মকাণ্ড দেখিয়ে ঢাকার একটি সংগঠন থেকে সম্মাননা পদক পান।জানতে চাইলে চৌধুরী জান্নাত বলেন, তিনি নিতুর অধিকার বাস্তবায়ন করতে কাজ করেছেন। নিতুর পরিবারের অভিযোগগুলো সঠিক নয়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কোন টাকা উত্তোলন করেননি। তবে স্থানীয় সাংসদ নিতুকে দেখে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে টাকা এনে দিবেন। তিনি সেই বিষয়টি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন।
তবে এত দুঃসংবাদের মাঝেও আশার কথা শুনিয়েছেন ঢাকার ফ্রিল্যান্স ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার জয়া করিম। তিনি জানান, গত ২৫ এপ্রিল PANDA আমেরিকার একটি ওয়েব সাইটে তিনি নিতুকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন শেয়ার করেন।এরপর তা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নিতুকে নিয়ে ফিচার করা হয়। গত ৮ মে ভারতের wsmagnum বোম্বের একটি পত্রিকায়ও একটি ফিচারটি চাপা হয়।
তা দেখে আমেরিকান প্রজেরিয়া ফাউন্ডেশন জয়া করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাঁর মাধ্যমে নিতুর মা-বাবার সঙ্গে সম্প্রতি মুঠোফোনে কথা বলেছেন তাঁরা। এবং নিতুকে আমেরিকার প্রজেরিয়া ফাউন্ডেশনের তালিকাভুক্ত করা কথা জানান। পাশাপাশি প্রজেরিয়া ফাউন্ডেশন সম্প্রতি নিতুর রক্ত সংগ্রহ করেছে।