দেশ দেখেছে ‘সাহস’, পুরুষ দেখেছে নারীর ঘুরে দাঁড়ানো রুদ্র রূপ
সাদিয়া নাসরিন।।
“-অভদ্র মেয়ে
-হ্যাঁ, আমি অভদ্র। কোন সমস্যা?
-বেয়াদব মেয়ে
-আপনি বেয়াদব
-এখন রাত কয়টা বাজে? রাত আড়াইটা বাজে।
-এখন রাত কয়টা বাজে? রাত আড়াইটা বাজে।
-তো সমস্যা কি? আমি সারারাত বাইরে থাকবো। আপনার কি?
-এতো তাড়া কেন? কেউ ওয়েট করতেসে?
-হ্যাঁ, আপনার বাপে ওয়েট করতেসে
-খারাপ মেয়ে
-হ্যাঁ, আমি খারাপ মেয়ে। আপনার সমস্যা কি?
-আরে! এ তো হোটেল থেকে নাইমা আসছে। আবার ঝাড়ি মারে!
-হ্যাঁ, হোটেল থেকে নামসি। বেআইনি কি করসি?
-এ তো পুরাই এডিক্টেড। মনে কইরেন না মাইয়া মানুষ বলে ছেড়ে দিবো। চ্যাংদোলা কইরা থানায় নিয়ে যাবো।
-এ–ই! চ্যাংদোলা করে নিতে হবেনা। আমি নিজে থানায় যাবো। আমি জানতে চাই আমার অপরাধ কি?”
বেচারা পুলিশ আর না পেরে বলেছিলো, “ডেমরা বাসা না? কাল দেখবা। মেয়েটি তড়িৎ উত্তর দিয়েছে, “‘বাল’ দেখবো”। আর আমরা সবাই দেখেছি ‘ভালো’। দেশ দেখেছে ‘সাহস’। পুরুষ দেখেছে নারীর ঘুরে দাঁড়ানো রুদ্র রূপ। সমাজ জেনে গেছে পুরুষের বানানো ওইসব ধ্বজভঙ্গ চরিত্রের চুল আর মেয়েরা ফ্যালেনা।
আহা ! ক…তো…দি….ন!! কতোদিন পর এমন আনন্দে বুঁদ হয়ে ছিলাম সারা দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত!! ভিড়িওটি বারবার দেখি, বারবার দেখি, বারবার দেখি। মেয়েটির চোখ দেখি, বসার ভঙ্গি দেখি, টানটান শিরদাঁড়া দেখি, আঙুল উঁচানো দেখি। কবে দেখেছিলাম এই রূপ?
এই আগুনের পাখি কোথা থেকে এসে আমার নিভে যাওয়া ছাইগুলো কুড়িয়ে এনে বারুদ ঘষে ঘষে এমন করে স্মৃতিভ্রম কাটিয়ে দিলো!! আমি জ্বলজ্বল করে দেখতে পেলাম দু’ বছর আগে বনানীর রাস্তায় একহাতে হেনস্থাকারী পুরুষের শার্টের কলার আরেক হাতে তার বাইক টেনে বাসার গ্যারাজে ঢুকাচ্ছি। সেদিনও পাশে জমায়েত পুরুষদের সেই আস্ফালন, “বেয়াদব মেয়ে!”
ও মেয়ে, তুমি কোথায় থাকো? আমি জানিনা মেয়েটি কোথায় থাকে। তবে আমি চিনি তাকে। কেমন সে দেখতে তা জানি। হেনস্থার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মেয়ের ঘুরে দাঁড়ানো দুর্গার খড়গহস্ত রণমুর্তি সে। পুরো দেশ এতোক্ষণে চিনে গেছে সেই ভয়ংকর সুন্দর আগুনের কণা। যে আগুন ছড়িয়ে গেছে সবখানে…।
যখন এই দেশের বিশাল বিশাল নারীরা পুরুষের প্রশ্নে “চরিত্র” হারানোর বেদনায় ভিক্টিম কার্ড খুলে বসে নারীবাদকে ব্যবহার করে পুরুষতন্ত্রের কাছেই বিচার চাইতে হাতে হাত ধরে দাঁড়ায়, তখন অতি সাধারণ, নাম না জানা, কোন ‘নারীবাদ’ না পুছা মেয়েটি মাঝরাতে পুলিশের পোষাক পরা তিনজন দানবের তান্ডবে এতোটুকুও কাঁচুমাচু না হয়ে, ঋজু হয়ে, গলা উঁচিয়ে, আঙুল তুলে, চোখে চোখ রেখে অনবরত প্রশ্ন করে গেছে, “আমি অভদ্র, কোন সমস্যা?” “আমি খারাপ মেয়ে, কোন সমস্যা?” “আমি হোটেল থেকে নামসি, কোন সমস্যা?” “আমি বেয়াদব, কোন সমস্যা?”
না, শুধু প্রশ্ন নয় এগুলো। কেবল উচ্চারনের শব্দ তো নয়! বরং নিপীড়ন, নিয়ন্ত্রণ, অপমান আর আপোসের মোহঘুম ভেঙে জেগে ওঠা সকালের আগমনি সঙ্গীত গেয়েছে মেয়েটি। মাঝরাতে রাজপথে একটা মেয়ের পথ আটকে পা ফাঁক করে দাঁড়ানো তিনটা পুরুষের বিচির হ্যাড়ম আর পুরুষতন্ত্রের আস্ফালনকে পা সিধা করে লাত্থি মেরে চুপসে দিয়ে নাক উঁচু করে ঘরে ফিরে গেছে আগুনের মেয়েটি।
এবং জানিয়ে গেছে এই যাওয়া শেষ যাওয়া নয় তার।সে বারবার ফিরে আসবে। এক থেকে একশো হবে, হাজার থেকে লক্ষ হবে। ভিনাসের মতো লক্ষ লক্ষ ডুবে যাওয়া মেয়ের সম্মিলিত শক্তির পুঁজি নিয়ে উঠে আসবে। আবাবিল পাখির ঝাঁক হয়ে ধ্বংসের বার্তা নিয়ে নেমে আসবে প্রতিবাদের, প্রতিরোধের মাঠে।
সেই মেয়েরা অপ্রতিরোধ্য আঙুলের শক্তিতে ও সাহসে প্রবল তাচ্ছিল্যে, অবজ্ঞায়, উন্নাসিকতায় লন্ডভন্ড করে দেবে অহঙ্কারী পুরুষতন্ত্রের ওই ফাঁপা সাম্রাজ্যবাদ। সেই ঘন্টা বেজে গেছে। কি মধুর সেই শব্দ!! আহা!!
লেখাটি ফেসবুক থেকে সংগৃহিত। প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য কর্তৃপক্ষ কোনও ধরনের দায় নেবে না।