মৃত বাবা-মায়ের জন্য যে আমলগুলো শিখিয়েছেন মহান আল্লাহ ও রাসুল (সঃ)
মা-বাবা ছোট্ট দুটি শব্দ। কিন্তু এ শব্দ দুটির সাথে জীবনের কত যে আদর, স্নেহ-মমতা ও ভালবাসা জড়িয়ে আছে তা কেবল অনুভবেই ধারণ করা সম্ভব; পৃথিবীর সকল পরিমাপযন্ত্র এখানে অচল।মা বাবা যাদের পৃথিবী থেকে চলে গেছে, তারা বুঝে এই কঠিন পৃথিবীতে মাথার উপর তারা কত বড় ছায়াবৃক্ষ হয়ে ছিলেন। তাদের বিয়োগ-বিরহে মাঝে মাঝেই ভেতর থেকে ব্যাথাগুলো অশ্রুজল হয়ে গড়িয়ে পড়ে না- কে আছে এমন সন্তান?
সেই চলে যাওয়া মা-বাবার জন্যে কি কি আমল করে আমরা তাদের পরজীবনে শান্তি পৌঁছাতে পারি- আলোচ্য প্রবন্ধে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাই উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। উদ্দেশ্য- যেন আমরা এক্ষেত্রে সমাজে প্রচলিত বিদআতগুলো পরিহার করে সহিহ সুন্নাহ সমর্থিত ও প্রমাণিত আমলগুলো করতে পারি। নিম্নে তা বিবৃত করা হল:
১. বেশী বেশী দু‘আ করা
মা-বাবা দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর সন্তান মা-বাবার জন্য বেশী বেশী দু‘আ করবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু‘আ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কী দু‘আ করবো তাও শিখিয়ে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে- رَبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا ٢٤
“হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন” (সূরা বানী ইসরাঈল- ২৪)
কুরআনে আরও এসেছে- رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيَّ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ يَوۡمَ يَقُومُ ٱلۡحِسَابُ ٤١ “হে আমাদের রব, রোজ কিয়ামতে আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিনকে ক্ষমা করে দিন।” (সুরা ইবরাহীম -৪১)
এছাড়া আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার জন্য দুআ করার বিশেষ নিয়ম শিক্ষা দিয়ে বলেন- رَّبِّ ٱغۡفِرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيۡتِيَ مُؤۡمِنٗا وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِۖ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّٰلِمِينَ إِلَّا تَبَارَۢا
“হে আমার রব! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন এবং ধ্বংস ছাড়া আপনি যালিমদের আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না।” (সূরা নুহ: ২৮)
মা-বাবা এমন সন্তান রেখে যাবেন যারা তাদের জন্য দোয়া করবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
অর্থ: মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩ টি আমল বন্ধ হয় না-১. সদকায়ে জারিয়া ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দু‘আ করে। (সহিহ মুসলিম: ৪৩১০)
মূলত: জানাযার নামায প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির জন্য দু‘আ স্বরূপ।
২. দান-ছাদকাহ করা, বিশেষ করে সদকায়ে জারিয়াহ প্রদান করাঃ
মা-বাবা বেচে থাকতে দান-সাদকাহ করে যেতে পারেন নি বা বেঁচে থাকলে আরো দান-সদকাহ করতেন, সেজন্য তাদের পক্ষ থেকে সন্তান দান-সদকাহ করতে পারে। হাদীসে এসেছে-
عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَجُلاً أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أُمِّىَ افْتُلِتَتْ نَفْسَهَا وَلَمْ تُوصِ وَأَظُنُّهَا لَوْ تَكَلَّمَتْ تَصَدَّقَتْ أَفَلَهَا أَجْرٌ إِنْ تَصَدَّقْتُ عَنْهَا قَالَ « نَعَمْ »
অর্থ: আয়েশা রা. আনহা বলেনঃ “জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমার মা হঠাৎ মৃতু বরণ করেছেন। তাই কোনো অছিয়ত করতে পারেন নি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-ছাদকা করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে ছাদকা করলে তিনি কি এর সাওয়াব পাবেন? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন।” (সহীহ মুসলিম:২৩৭৩)
তবে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে সদকায়ে জারিয়াহ বা প্রবাহমান ও চলমান সদকা প্রদান করা। যেমন পানির কুপ খনন করা, (নলকুপ বসানো, দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, কুরআন শিক্ষার জন্য মক্তব ও প্রতিষ্ঠান তৈরী করা, স্থায়ী জনকল্যাণমূলক কাজ করা। ইত্যাদি।
৩. মা-বাবার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন
মা-বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় যদি তাদের কোনো মানতের সিয়াম কাযা থাকে, সন্তান তাদের পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করলে তাদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আয়েশা রা. আনহা হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ صِيَامٌ صَامَ عَنْهُ وَلِيُّهُ অর্থ: “যে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করল এমতাবস্থায় যে তার উপর রোযা ওয়াজিব ছিল।
তবে তার পক্ষ থেকে তার ওয়ারিসগণ রোযা রাখবে।” (সহীহ বুখারী:১৯৫২) অধিকাংশ আলেমগণ এ হাদীসটি শুধুমাত্র ওয়াজিব রোযা বা মানতের রোযার বিধান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে নফল সিয়াম রাখার পক্ষে দলীল নাই।
৪. হজ্জ বা উমরাহ করা
মা-বাবার পক্ষ থেকে হজ্জ বা উমরাহ করলে তা আদায় হবে এবং তারা উপকৃত হবে। ইবনে আববাস রা. মা হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে-
أَنَّ امْرَأَةً مِنْ جُهَيْنَةَ جَاءَتْ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَتْ إِنَّ أُمِّي نَذَرَتْ أَنْ تَحُجَّ فَلَمْ تَحُجَّ حَتَّى مَاتَتْ أَفَأَحُجُّ عَنْهَا قَالَ نَعَمْ حُجِّي عَنْهَا أَرَأَيْتِ لَوْ كَانَ عَلَى أُمِّكِ دَيْنٌ أَكُنْتِ قَاضِيَةً اقْضُوا اللَّهَ فَاللَّهُ أَحَقُّ بِالْوَفَاءِ
অর্থ: “জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে আগমণ করে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা হজ্জ করার মানত করেছিলেন কিন্তু তিনি হজ্জ সম্পাদন না করেই মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, “তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ্জ কর।
তোমার কি ধারণা যদি তোমার মার উপর ঋণ থাকতো তবে কি তুমি তা পরিশোধ করতে না ? সুতরাং আল্লাহর জন্য তা আদায় কর। কেননা আল্লাহর দাবী পরিশোধ করার অধিক উপযোগী” (সহীহ বুখারী: ১৮৫২) । তবে মা-বাবার পক্ষ থেকে যে লোক হজ্জ বা ওমরাহ করতে চায় তার জন্য শর্ত হলো সে আগে নিজের হজ্জ-ওমরাহ করতে হবে।
৫. মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানী করা
মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানী করলে তার ছাওয়াব দ্বারা তারা উপকৃত হবে। এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে- عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَمَرَ بِكَبْشٍ أَقْرَنَ يَطَأُ فِى سَوَادٍ وَيَبْرُكُ فِى سَوَادٍ وَيَنْظُرُ فِى سَوَادٍ فَأُتِىَ بِهِ لِيُضَحِّىَ بِهِ فَقَالَ لَهَا « يَا عَائِشَةُ هَلُمِّى الْمُدْيَةَ » ثُمَّ قَالَ « اشْحَذِيهَا بِحَجَرٍ ». فَفَعَلَتْ ثُمَّ أَخَذَهَا وَأَخَذَ الْكَبْشَ فَأَضْجَعَهُ ثُمَّ ذَبَحَهُ ثُمَّ قَالَ « بِاسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ ». ثُمَّ ضَحَّى بِهِ
অর্থ: আয়েশা রা. আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. এমন একটি শিংযুক্ত দুম্বা উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলেন, যার পা কালো, চোখের চতুর্দিক কালো এবং পেট কালো। অতঃপর তা কুরবানীর জন্য আনা হলো। তখন রাসূলুল্লাহ সা. আয়েশা রা. আনহাকে বললেন, হে আয়েশা! ছুরি নিয়ে আস, তারপর বললেন, তুমি একটি পাথর নিয়ে তা দ্বারা এটাকে ধারালো কর।
তিনি তাই করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সা. ছুরি হাতে নিয়ে দুম্বাটিকে শুইয়ে দিলেন। পশুটি যবেহ্ করার সময় বললেন, বিসমিল্লাহ, হে আল্লাহ তুমি এটি মুহাম্মাদ, তাঁর বংশধর এবং সকল উম্মাতে মুহাম্মাদীর পক্ষ থেকে কবুল কর”। এভাবে তিনি তা দ্বারা কুরবানী করলেন। (সহীহ মুসলিম: ৫২০৩)
৬. মা-বাবার ওসিয়ত পূর্ণ করা
মা-বাবা শরীয়াহসম্মত কোন ওসিয়ত করে গেলে তা পূর্ণ করা সন্তানদের উপর দায়িত্ব। রাশীদ ইবনে সুয়াইদ আসসাকাফী রা. বলেন-
قُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، إِنَّ أُمِّي أَوْصَتْ أَنْ نُعْتِقُ عَنْهَا رَقَبَةً ، وَعِنْدِي جَارِيَةٌ سَوْدَاءُ ، قَالَ : ادْعُ بِهَا ، فَجَاءَتْ ، فَقَالَ : مَنْ رَبُّكِ ؟ قَالَتِ : اللَّهُ ، قَالَ : مَنْ أَنَا ؟ قَالَتْ : رَسُولُ اللَّهِ ، قَالَ : أَعْتِقْهَا ، فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ
অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ সা. কে বললাম হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা একজন দাসমুক্ত করার জন্য ওসিয়ত করে গেছেন। আর আমার নিকট কালো একজন দাসী আছে। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তাকে ডাকো, সে আসল, রাসূলুল্লাহ সা. তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার রব কে ? উত্তরে সে বলল, আমার রব আল্লাহ। আবার প্রশ্ন করলেন আমি কে? উত্তরে সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসুল। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও; কেন না সে মু’মিনাহ। (সহীহ ইবনে হিববান :১৮৯)
৭. মা-বাবার বন্ধুদের সম্মান করা
মা-বাবার বন্ধুদের সাথে ভাল ব্যবহার করা, সম্মান করা, তাদেরকে দেখতে যাওয়া,তাদেরকে হাদিয়া দেয়া। এ বিষয়ে হাদীসে উল্লেখ আছে,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ دِينَارٍ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّ رَجُلاً مِنَ الأَعْرَابِ لَقِيَهُ بِطَرِيقِ مَكَّةَ فَسَلَّمَ عَلَيْهِ عَبْدُ اللَّهِ وَحَمَلَهُ عَلَى حِمَارٍ كَانَ يَرْكَبُهُ وَأَعْطَاهُ عِمَامَةً كَانَتْ عَلَى رَأْسِهِ فَقَالَ ابْنُ دِينَارٍ فَقُلْنَا لَهُ أَصْلَحَكَ اللَّهُ إِنَّهُمُ الأَعْرَابُ وَإِنَّهُمْ يَرْضَوْنَ بِالْيَسِيرِ. فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ إِنَّ أَبَا هَذَا كَانَ وُدًّا لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ وَإِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ « إِنَّ أَبَرَّ الْبِرِّ صِلَةُ الْوَلَدِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ ».
অর্থ: আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার রা. আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণনা করেন, একবার মক্কার পথে চলার সময় আব্দুল্লাহ রা. এর এক বেদুঈন এর সাথে দেখা হলে তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং তাকে সে গাধায় চড়ালেন যে গাধায় আব্দুল্লাহ রা. উপবিষ্ট ছিলেন এবং তাঁর (আব্দুল্লাহ) মাথায় যে পাগড়িটি পরা ছিলো তা তাকে প্রদান করলেন।
আব্দুল্লাহ ইবান দীনার রাহেমাহুল্লাহ বললেন, তখন আমরা আব্দুল্লাহকে বললাম: আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক! এরা গ্রাম্য মানুষ: সামান্য কিছু পেলেই এরা সন্তুষ্ট হয়ে যায়-(এতসব করার কি প্রয়োজন ছিলো?) উত্তরে আব্দুল্লাহ রা. বললেন, তার পিতা, (আমার পিতা) উমার ইবনে খাত্তাব রা. এর বন্ধু ছিলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি “পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ভাল ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় সওয়াবের কাজ” (সহীহ মুসলিম:৬৬৭৭)
মৃতদের বন্ধুদের সাথে রাসূলুল্লাহ সা. এর আমলও আমাদেরকে উৎসাহিত করে। আয়েশা রা. আনহা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে- إِذَا ذَبَحَ الشَّاةَ فَيَقُولُ أَرْسِلُوا بِهَا إِلَى أَصْدِقَاءِ خَدِيجَةَ
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সা. যখনই কোন বকরী যবেহ করতেন, তখনই তিনি বলতেন, এর কিছু অংশ খাদীজার বান্ধবীদের নিকট পাঠিয়ে দাও (সহীহ মুসলিম: ৬৪৩১)
৮. মা-বাবার আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখা
সন্তান তার মা-বাবার আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَصِلَ أَبَاهُ فِي قَبْرِهِ ، فَلْيَصِلْ إِخْوَانَ أَبِيهِ بَعْدَهُ ‘যে ব্যক্তি তার পিতার সাথে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালবাসে, সে যেন পিতার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখে’ (সহীহ ইবনে হিববান:৪৩২)
৯. ঋণ পরিশোধ করা
মা-বাবার কোন ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধ করা সন্তানদের উপর বিশেষভাবে কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ সা. ঋণের পরিশোধ করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- نَفْسُ الْمُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهً حَتَّى يُقْضَى عَنْهُ “মুমিন ব্যক্তির আত্মা তার ঋণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে যায়; যতক্ষণ তা তা তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হয়”। (সুনানে ইবনে মাজাহ:২৪১৩)
ঋণ পরিশোধ না করার কারণে জান্নাতে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়; এমনকি যদি আল্লাহর রাস্তায় শহীদও হয় । হাদীসে আরো এসেছে- «مَا دَخَلَ الْجَنَّةَ حَتَّى يُقْضَى دَيْنُهُ» অর্থ: যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দার ঋণ পরিশোধ না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (নাসায়ী ৭/৩১৪; তাবরানী ফিল কাবীর ১৯/২৪৮; মুস্তাদরাকে হাকিম ২/২৯)
১০. কাফফারা আদায় করা
মা-বাবার কোন শপথের কাফফারা,ভুলকৃত হত্যাসহ কোন কাফফারা বাকী থাকলে সন্তান তা পূরণ করবে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে-
﴿وَمَن قَتَلَ مُؤۡمِنًا خَطَٔٗا فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٖ مُّؤۡمِنَةٖ وَدِيَةٞ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦٓ إِلَّآ أَن يَصَّدَّقُواْۚ ﴾
অর্থ: যে ব্যক্তি ভুলক্রমে কোন মুমিনকে হত্যা করবে, তাহলে একজন মুমিন দাসকে মুক্ত করতে হবে এবং দিয়াত (রক্ত পণ দিতে হবে) যা হস্তান্তর করা হবে তার পরিজনদের কাছে। তবে তারা যদি সদাকা (ক্ষমা) করে দেয় (তাহলে সেটা ভিন্ন কথা)। (সূরা আন-নিসা:৯২)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন- مَنْ حَلَفَ عَلَى يَمِينٍ فَرَأَى غَيْرَهَا خَيْرًا مِنْهَا فَلْيَأْتِهَا وَلْيُكَفِّرْ عَنْ يَمِينِه অর্থ: “যে ব্যক্তি কসম খেয়ে শপথ করার পর তার থেকে উত্তম কিছু করলেও তার কাফফারা অদায় করবে।” (সহীহ মুসলিম: ৪৩৬০)
এ বিধান জীবিত ও মৃত সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। দুনিয়ার বুকে কেউ অন্যায় করলে তার কাফফারা দিতে হবে। অনুরূপভাবে কেউ অন্যায় করে মারা গেলে তার পরিবার-পরিজন মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কাফফারা প্রদান করবেন।
১১. ক্ষমা প্রার্থনা করা
মা-বাবার জন্য আল্লাহর নিকট বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করা গুরুত্বপূর্ণ আমল। সন্তান মা-বাবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করায় আল্লাহ তা‘আলা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। হাদীসে বলা হয়েছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ : تُرْفَعُ لِلْمَيِّتِ بَعْدَ مَوْتِهِ دَرَجَتُهُ . فَيَقُولُ : أَيْ رَبِّ ، أَيُّ شَيْءٍ هَذِهِ ؟ فَيُقَالُ : وَلَدُكَ اسْتَغْفَرَ لَكَ
অর্থ: আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মৃত্যুর পর কোন বান্দাহর মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। তখন সে বলে হে আমার রব, আমি তো এতো মর্যাদার আমল করিনি, কীভাবে এ আমল আসলো ? তখন বলা হবে, তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করায় এ মর্যাদা তুমি পেয়েছো।” (আল-আদাবুল মুফরাদ:৩৬)
মা-বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পর তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার বিষয়ে উসমান রা. বর্ণিত হাদীসে এসেছে- عَنْ عُثْمَانَ ، قَالَ : وَقَفَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى قَبْرِ رَجُلٍ وَهُوَ يُدْفَنُ فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهُ قَالَ : اسْتَغْفِرُوا لأَخِيكُمْ وَسَلُوا اللَّهَ لَهُ بالثَّبَاتِ ؛ فَإِنَّهُ يُسْأَلُ الآنَ অর্থ: উসমান রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. কোন এক মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর তার কবরের পার্শ্বে দাঁড়ালেন এবং বললেন “তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার জন্য ঈমানের উপর অবিচলতা ও দৃঢ়তা কামনা কর, কেননা এখনই তাকে প্রশ্ন করা হবে।” (মুসনাদুল বাজ্জার :৪৪৫)
তাই সুন্নাত হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিকে কবরে দেয়ার পর তার কবরের পার্শ্বে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার জন্য প্রশ্নোত্তর সহজ করে দেয়া, প্রশ্নোত্তর দিতে সমর্থ হওয়ার জন্য দো‘আ করা।
১২. মান্নত পূরণ করা
মা-বাবা কোন মান্নত করে গেলে সন্তান তার পক্ষ থেকে পূরণ করবে। ইবনে আববাস রা. মা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে- أَنَّ امْرَأَةً نَذَرَتْ أَنْ تَصُومَ شَهْرًا فَمَاتَتْ فَأَتَى أَخُوهَا النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ :« صُمْ عَنْهَا অর্থ: কোন মহিলা রোযা রাখার মান্নত করেছিল, কিন্তু সে তা পূরণ করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করল। এরপর তার ভাই এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট আসলে তিনি বলরেন, তার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন কর। (সহীহ ইবনে হিববান:২৮০)
১৩. মা-বাবার ভাল কাজসমূহ জারী রাখা
মা-বাবা যেসব ভাল কাজ অর্থাৎ মসজিদ তৈরী করা, মাদরাসা তৈরী করা, দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীসহ যে কাজগুলো করে গিয়েছেন সন্তান হিসাবে তা যাতে অব্যাহত থাকে তার ব্যবস্থা করা। কেননা এসব ভাল কাজের সওয়াব তাদের আমলনামায় যুক্ত হতে থাকে। হাদীসে এসেছে- مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ “ভাল কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে”। (সুনান আততিরমীযি : ২৬৭০)
হাদিসে আরও এসেছে-مَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَهُ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَىْءٌ “যে ব্যক্তির ইসলামের ভাল কাজ শুরু করল, সে এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে। অথচ তাদেও সওয়াব থেকে কোন কমতি হবে না।” (সহীহ মুসলিম:২৩৯৮)
১৪. কবর যিয়ারত করা
সন্তান তার মা-বাবার কবর যিয়ারত করবে। এর মাধ্যমে সন্তান এবং মা-বাবা উভয়ই উপকৃত হবে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَقَدْ أُذِنَ لِمُحَمَّدٍ فِى زِيَارَةِ قَبْرِ أُمِّهِ فَزُورُوهَا فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الآخِرَةَ অর্থ: আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, অত:পর মুহাম্মাদের মায়ের কবর যিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এখন তোমরা কবর যিয়রাত কর, কেননা তা আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। (সুনান তিরমীযি :১০৫৪)
কবর যিয়ারত কোন দিনকে নির্দিষ্ট করে করা যাবে না। কবর যিযারত করার সময় বলবে-
السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاَحِقُونَ ، نَسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ অর্থ: কবরবাসী মুমিন-মুসলিম আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক । নিশ্চয় আমরা আপনাদের সাথে মিলিত হবো। আমরা আল্লাহর কাছে আপনাদের এবং আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। (সুনান ইবনে মাজাহ :১৫৪৭)
১৫. ওয়াদা করে গেলে তা বাস্তবায়ন করা
মা-বাবা কারো সাথে কোন ভাল কাজের ওয়াদা করে গেলে বা এমন ওয়াদা যা তারা বেচে থাকলে করে যেতেন, সন্তান যথাসম্ভব তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে- وَأَوۡفُواْ بِٱلۡعَهۡدِۖ إِنَّ ٱلۡعَهۡدَ كَانَ مَسُۡٔولٗا অর্থ: আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ( সূরা বনী ইসরাঈল:৩৪)
১৬. কোন গুনাহের কাজ করে গেলে তা বন্ধ করা
মা-বাবা বেচে থাকতে কোন গুনাহের কাজের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তা বন্ধ করবে বা শরীয়াহ সম্মতভাবে সংশোধন করে দিবে। কেননা আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا “এবং যে মানুষকে গুনাহের দিকে আহবান করবে, এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ গুনাহ তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের গুনাহ থেকে কোন কমতি হবে না।” (সহীহ মুসলিম:৬৯৮০)
১৭. মা-বাবার পক্ষ থেকে মাফ চাওয়া
মা-বাবা বেচে থাকতে কারো সাথে খারাপ আচরণ করে থাকলে বা কারো উপর যুলুম করে থাকলে বা কাওকে কষ্ট দিয়ে থাকলে মা-বাবার পক্ষ থেকে তার কাছ থেকে মাফ মাফ চেয়ে নিবে অথবা ক্ষতি পূরণ দিয়ে দিবে। কেননা হাদীসে এসেছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ : أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ : أَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ ؟ قَالُوا : الْمُفْلِسُ فِينَا يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ ، وَلاَ مَتَاعَ لَهُ ، فَقَالَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : الْمُفْلِسُ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَتِهِ وَصِيَامِهِ وَزَكَاتِهِ ، فَيَأْتِي وَقَدْ شَتَمَ هَذَا ، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا ، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا ، فَيَقْعُدُ ، فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُعْطِيَ مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ ، فَطُرِحَ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ
“আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কি জান নিঃস্ব ব্যক্তি কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরীব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো গরীব, যে কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল আত্মসাৎ করেছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে।
কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল নামা দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (সুনানে তিরমিযি :২৪২৮)
সুতরাং এ ধরনের নিঃস্ব ব্যক্তিকে মুক্ত করার জন্য তার হকদারদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া সন্তানের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
মহান রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে আমাদের পিতা-মাতার জন্য আমলগুলো করার তাওফীক দিন। আমীন!