শুক্রবার, ১৯শে অক্টোবর, ২০১৮ ইং ৪ঠা কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

ম্যাচের আগে ২০ বার বাথরুমে যান মেসি!

লিওনেল মেসি ও ডিয়েগো ম্যারাডোনা-দুজন যেন জমজমাট কোনো রহস্য উপন্যাসের চরিত্র। অধিকাংশ ধারাভাষ্যকার, ফুটবল বিশেষজ্ঞ, কোচ এবং খেলোয়াড় মেসিকে বর্তমান সময়ের সেরা এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে গন্য করে থাকেন। অন্যদিকে সবদিক থেকেই এগিয়ে ম্যারাডোনা।

কিন্তু তাদের সম্পর্ক নিয়ে রয়েছে নানান বিতর্ক। কখনো মেসিকে বিশ্বসেরা বলছেন ম্যারাডোনা, অন্যদিন কখনো বা ‘ধুর, কিচ্ছু পারে না’ বলে ক্ষোভ ঝাড়ছেন। এই তো কিছুদিন আগে বললেন, আর্জেন্টিনাই মেসিকে পাওয়ার যোগ্য দল না। মেসির উচিত আর্জেন্টিনা দল থেকে অবসর নেওয়া। আবার সম্প্রতি মেসির তীব্র সমালোচনা করেছেন, বার্সেলোনার অধিনায়ককে জাতীয় দলের নেতৃত্ব দেওয়ার মানে হয় না। কারণ মেসি চাপ নিতে পারেন না।

সম্প্রতি, মেক্সিকোতে ‘লা আল্টিমা প্যালাব্রা’ নামের এক টিভি অনুষ্ঠানে ম্যারাডোনা বলেছেন, ‘সে (মেসি) মাঠে এটা (নেতৃত্ব) বুঝে নিতে চায়। কিন্তু সতীর্থদের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে সে প্লে স্টেশনে (ভিডিও গেম) খেলতে বেশি পছন্দ করে। আমার জন্য এটা নিয়ে কথা বলা কঠিন। কিন্তু একটা মানুষকে আপনি নেতা বানাতে পারবেন না, যে ম্যাচের আগে ২০ বার বাথরুমে যায়!’ ক্লাবের মেসির সঙ্গে আর্জেন্টিনার মেসিকে মিলিয়ে ফেলতে মানা করেছেন ম্যারাডোনা, ‘বার্সেলোনার মেসি হলো বার্সেলোনার, আর আর্জেন্টিনার মেসি হলো আর্জেন্টিনার। আমি মেসিকে ডাকব না (নেতৃত্বের জন্য) কিন্তু কখনোই বলা যায় না “কখনো না।”’

লিওনেল মেসি রেকর্ড পাঁচটি ব্যালন ডি অর জয় করেছেন যার মধ্যে চারটি তিনি জিতেছেন টানা চার বছরে। পাশাপাশি তিনি রেকর্ড পাঁচবার ইউরোপীয় গোল্ডেন শু ও জিতেছেন। তিনি তার পুরো পেশাদার জীবন পার করেছেন বার্সেলোনায় যেখানে তিনি মোট ৩৩টি ট্রফি জিতেছেন যার মধ্যে রয়েছে ৯টি লা লিগা, ৪টি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ এবং ৬টি কোপা দেল রে। একজন অসাধারণ গোলদাতা হিসেবে মেসির দখলে রয়েছে লা লিগায় সর্বোচ্চ গোল (৩৮৫), লা লিগায় এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোল (৫০), ইউরোপে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোল (৭৩), এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ গোল (৯১) এবং এল ক্লাসিকোর ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলের (২৬) রেকর্ড। পাশাপাশি মেসি একজন সৃষ্টিশীল প্লেমেকার হিসেবেও সেরা। তিনি লা লিগার (১৪৯) এবং কোপা আমেরিকা (১১) ইতিহাসের সর্বোচ্চ সহায়তাকারীর রেকর্ডেরও মালিক। জাতীয় দল এবং ক্লাবের হয়ে তিনি ৬০০-এর অধিক পেশাদার গোল করেছেন।

মধ্য আর্জেন্টিনায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মেসি ছোট বেলায় গ্রোথ হরমোন সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হন। ১৩ বছর বয়সে তিনি বার্সেলোনায় যোগ দিতে স্পেনে স্থানান্তরিত হন কারণ তারা তার চিকিৎসার খরচ বহনের দায়িত্ব নিয়েছিল। বার্সেলোনার যুব প্রকল্পে দ্রুত অগ্রগতির মধ্য দিয়ে ১৭ বছর বয়সে ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে তার বার্সেলোনা মূল দলে অভিষেক হয়। ক্যারয়ারের শুরুতে ইঞ্জুরি প্রবণ হলেও ২০০৭ সাল নাগাদ তিনি নিজেকে ক্লাবের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেন।

২০০৭ সালের ব্যালন ডি অর এবং ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কারে তিনি প্রথম তিনজনের একজন হিসেবে স্থান করে নেন এবং পরবর্তী বছর তিনি উভয় পুরস্কার জয় করেন। তার প্রথম অবিচ্ছিন্ন মৌসুম ছিল ২০০৮-০৯ যেখানে তিনি বার্সেলোনাকে ট্রেবল জয়ে সাহায্য করেন। ২২ বছর বয়সে মেসি রেকর্ড ভোটের ব্যবধানে বালোঁ দর এবং ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার জয় করেন।

পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে মেসির সেরা মৌসুম ছিল ২০১১-১২, যখন তিনি লা লিগা এবং ইউরোপে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়েন এবং বার্সেলোনার ইতিহাসের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। মেসির সেরা ফর্মের আরেকটি ঝলক দেখা যায় ২০১৪-১৫ মৌসুমে যখন তিনি লা লিগা এবং উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভেঙে দেন এবং বার্সেলোনাকে ঐতিহাসিক দ্বিতীয় ট্রেবল জয়ে সাহায্য করেন। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে মেসি বার্সেলোনার অধিনায়কের দায়িত্ব লাভ করেন।

মেসি আর্জেন্টিনার ইতিহাসের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে মেসি আর্জেনটিনাকে ২০০৫ ফিফা ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতাতে সাহায্য করেন যে টুর্নামেন্টে তিনি সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জয় করেন। এছাড়া তিনি ২০০৮ গ্রীষ্মকালীন অলম্পিকে তিনি স্বর্ণপদক জয় করেন। ২০০৫ সালের অগাস্টে তার আর্জেন্টিনা জাতীয় দল এ তার অভিষেক হয়।

২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপ এ গোল করার মধ্য দিয়ে তিনি সর্বকনিষ্ঠ আর্জেন্টাইন হিসেবে বিশ্বকাপে গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। ২০০৭ কোপা আমেরিকায় তিনি টুর্নামেন্ট সেরা যুব খেলোয়াড়ের পুরস্কার লাভ করেন যে টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনা রানার-আপ হয়। ২০১১ সালের অগাস্টে তিনি আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান। অধিনায়ক হিসেবে তিনি আর্জেন্টিনাকে টানা তিনটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে তোলেন: ২০১৪ ফিফা বিশ্বকাপ, ২০১৫ কোপা আমেরিকা এবং ২০১৬ কোপা আমেরিকা। তিনি ২০১৪ ফিফা বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল অর্জন করেন।

২০১৮ বিশ্বকাপে ব্যর্থতার দায় নিয়ে হোর্হে সাম্পাওলি বিদায় নিয়েছেন। লিওনেল স্ক্যালোনির অধীনে তিনটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছে আর্জেন্টিনা। এর কোনোটিতেই মেসি ছিলেন না। আপাতত আর্জেন্টিনা দল থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন মেসি। আর্জেন্টিনার হয়ে আর কখনো তাঁকে দেখা যাবে কি যাবে না, এ নিয়েও শঙ্কা আছে।

তবে তাঁর জন্য ১০ নম্বর জার্সিটা তুলে রেখেছেন স্ক্যালোনি। অধিনায়কত্বটা যে ফিরে পাবেন, সেটা নিশ্চিত। মেসি এর মাঝেই দুটি বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশকে। ক্লাবের নেতৃত্বও পাকাপাকিভাবে বুঝে পেয়েছেন এ মৌসুমে। এখন তো নেতৃত্বের ব্যাপারটা একদমই সহজ হয়ে যাবে তাঁর জন্য।

কিছুদিন আগেই যে মেসিকে আর্জেন্টিনা দল থেকে অবসর নিতে বলেছেন, সেটা আর মনে রাখছেন না ম্যারাডোনা। বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন, আর্জেন্টিনা দলের মেসিকে ছাড়া চলবে না। তবে তাঁর দাবি মেসিকে ডাকলেও অধিনায়ক করা ঠিক হবে না, ‘ওর ওপর থেকে চাপ সরানো দরকার। মেসির কাজ থেকে নেতৃত্ব নিয়ে নিতে হবে। কারণ, আমরা চাই সে মেসি হিসেবেই খেলুক। কিন্তু নেতৃত্ব থাকলে সে কখনো মেসি হতে পারবে না (আর্জেন্টিনা দলে)।’