‘পকেটে মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম’
এই রুপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাব দুরে, বহুদূরে সেদিন অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে— গানের মাধ্যমে এভাবেই হয়তো চলে যাওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু বড় অবেলায় ভক্তদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন তিনি।
আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৬২ সালে। রক সংগীতকে যখন জীবনের ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেন তখন তার বয়স মাত্র ১৬ বছর। ঢাকায় এসে খ্যাতির চূড়ায় আরোহণ করলেও জীবনের নানা চড়াই পার হতে হয়েছে তাকে। বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎকারে ‘এবি’ হয়ে ওঠার গল্প বলেছেন তিনি।
২০১৬ সালে স্বনামধন্য পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমার সন্তানেরা ছোটবেলা থেকে আমার মুখে একটা গল্প শুনে অভ্যস্ত। এই ঢাকা শহরে ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে এসেছিলাম। উঠেছিলাম এলিফ্যান্ট রোডের একটি হোটেলে।
ঢাকা শহরে আমি যখন ৬০০ টাকা নিয়ে আসি, তখন এখানে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন থাকতেন। আমি কারও কাছেই যাইনি। বিপদে কারও মুখাপেক্ষীও হইনি। নিজেকে গড়ে তুলেছি। কাজে হাত দিয়েছি। কাজের পর কাজ করেছি। এখনো করেই যাচ্ছি। দিনরাত্রি কাজ করে একটা অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি।
আমার কাছে ওই ৬০০ টাকা ছিল ৬ কোটি টাকার মতোই। সামনে অনেক পথ খোলা ছিল। সবকিছু পাশ কাটিয়ে গেছি। চলার পথে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ছিল, যাদের নাম শুনলে আতঙ্কিত হতে হতো। শুধু তা-ই নয়, আমার পরিচিত অনেকে মাদকসেবনও করত। চাইলে আমিও হয়তো বখে যেতে পারতাম। কিন্তু মিউজিকই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। আমি সেই লক্ষ্যে ছুটে গেছি।
১০ বছর লেগেছে আমার সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে। এই ১০ বছরে আমি ভেসে যেতে পারতাম। হয়তো আমার কোনো পাত্তাই পাওয়া যেত না। কিন্তু আমি ভাসিনি। আশপাশে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। অনেক ধরনের লাইফস্টাইলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। কিন্তু যে লাইফস্টাইল আমার পরিচিত না, যেটার সঙ্গে আমার পরিবার একমত না—এ ধরনের লাইফস্টাইল থেকে নিজেকে সংবরণ করেছি। কারণ, আমার মা কষ্ট পেলে দেশ কষ্ট পাবে। আত্মীয়স্বজনেরা মন ছোট করবেন। দেশ কষ্ট পেলে দুনিয়া কষ্ট পাবে। এ জন্যই নিজেকে সংবরণ করেছি। আমি বলতে চাই, লোভ সংবরণ করা খুব দরকার।
এ বছরের ১৬ আগস্ট নিজের শেষ জন্মদিন উদযাপন করেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তার ঠিক এক বছর আগে দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জীবন-মৃত্যু নিয়ে নিজের উপলব্ধির কথা বলেছিলেন।
‘চোখ মেললেই জীবন। চোখ বন্ধ করলেই আর জীবন নেই। জীবনের রংটাই এরকম। আমাদের সবার ক্ষেত্রে বিষয়টি একইরকম। জীবন সে তো তার মতো করেই চলবে। কাউকে বলে কয়ে চলবে না। আমরা কেউ জানি না ঠিক পর মুহূর্তে কী হতে যাচ্ছে।’
যে মানুষটি চিরদিন ব্যক্তিগত খ্যাতি বা চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে থেকে পারিবারিক মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরে জীবন যাপন করেছেন, সব সময় দেশের কথা বলতেন সেদিন জন্মদিন হলেও মৃত্যুর ভাবনাটাই যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাকে। অনুপ্রেরণার কথা জিজ্ঞাসা করতেই বলেছিলেন, ‘আগের মতো এখন অনেক কিছুই আমাকে আর অনুপ্রাণিত করে না। এখন বেঁচে থাকাটা আমার ভক্ত-শ্রোতাদের জন্য, যারা আমাকে ভালোবাসেন। যারা আমার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভেজেন। যারা প্রচণ্ড রোদে পুড়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করেন। যারা আমার প্রতি স্নেহ-মমতা প্রকাশ করেন। এখন নতুন কোন স্বপ্ন দেখি না যার জন্য আমাকে বেঁচে থাকতেই হবে।’