স্বামীকে সব বলে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং! অতঃপর …
মিষ্টির সেলফোনটা অনবরত বেজেই যাচ্ছে। সেটের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে তার বন্ধুর নাম। বাচ্চু।
আগে একটা সময় বাচ্চুর ফোন আসলেই তড়িঘড়ি করে ফোন ধরতেন মিষ্টি। এখন ওর ফোন আসলেই তার বুক কাঁপে। মাঝে মধ্যে ভাবতে থাকে, যদি এই নম্বর থেকে আর কখনো ফোন না আসত, বেঁচে যেত।
কিন্তু ওর ফোন না ধরলেও বিপদ। ম্যাসেজ দেয়। উল্টাপাল্টা কথা লিখে। ভয় আরও বাড়ে। তার স্বামী সন্তান যদি জানতে পারে! ভেঙে যাবে সংসার। এমন সব ভয়ে প্রতিবারের মতো সেদিনও ফোন রিসিভ করল মিষ্টি। ওপাশে বাচ্চুর কণ্ঠ। ‘কী ব্যাপার ফোন ধরছ না কেন? ফোন ধরতে ইচ্ছা হয় না?
দেখ তোমাকে বার বার বলেছি, আমি কল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করবা। কেউ আমার ফোন রিসিভ না করলে মাথায় রক্ত উঠে যায়। আর তুমি তো আমার স্পেশাল মানুষ। তুমি ফোন ধরতে দেরি করলে কী করতে কী করে ফেলব, নিজেও জানো না। যাই হোক বেশি কথা বলে লাভ নেই। চলে আসো।
গুলশানে আগের জায়গায়। অপেক্ষা করছি আমি। আমার কিছু ক্লায়েন্ট এসেছে। সময় দিতে হবে তোমাকে। প্রস্তুতি নিয়ে এসো।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো যখন বলছিল মিষ্টি ছিল একদম চুপ।
বাচ্চুর কথা শেষে মিষ্টি মুখ খোলে। ‘আমি পারব না। আমার স্বামী-সন্তান এখন বাসায় আছে। আজ কেন, আর কখনো যেতে পারব না। আমার জীবনটা ফিরিয়ে দাও।
আমি আর পারছি না। তোমার অন্যায় আবদার শুনতে আমি আর পারব না।’ এ কথা শুনেই বাচ্চু অট্টহাসি হাসে। বলে, ওকে। ঠিক আছে। আসার দরকার নেই। তোমার স্বামী যখন বাসাতেই আছে, ভালোই হবে।
আমি তাকে কল দিচ্ছি আরেক নম্বর দিয়ে। তুমি শুনতে থাকো। দেখো কী বলছি তোমার স্বামীকে। আর তোমার আমার সেই ভিডিওগুলো তো সব রেডি করাই আছে।
আমার সঙ্গে কেন, আরও যে কজনের সঙ্গে ছিলে, সেই ভিডিওগুলোও তো রয়েছে। ইন্টারনেটে একসঙ্গে ছেড়ে দেব। বেশি কষ্ট করতে হবে না। তখন তোমার স্বামী সন্তান নিয়ে থেকো।’
বাচ্চুর এমন সব কথা শুনে কান্না করতে থাকে মিষ্টি। বলে, ঠিক আছে আমি আসছি। রাতে বাসায় ফিরে এসে কিছুই ভাবতে পারছে না মিষ্টি।
বছরের পর বছর বাচ্চুর অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে তাকে। এ পথ থেকে আর সরতেও পারছে না। দিনে রাতে শুধু ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে বাচ্চু। ব্লাকমেইলিং করছে দিনের পর দিন।
বেশ কয়েক মাস হয়ে গেছে এখন শুধু বাচ্চুই নয়, তার বন্ধুদের সঙ্গেও বিছানায় যেতে হচ্ছে তাকে। তার কোথাকার ক্লায়েন্ট আসে, সেখানেও তাকে যেতে হচ্ছে।
আর টাকা পয়সা তো নিয়মিত নিচ্ছেই বাচ্চু। কারও কাছে সে বলতেও পারছে না, সহ্য করতেও পারছে না। কিন্তু একটা সময় দুজনের সঙ্গে কত ভালো সম্পর্ক ছিল। বাচ্চুরও স্ত্রী-সন্তান আছে। রং নম্বর থেকে প্রথমে ফোনটা আসে। পরে একই নম্বর থেকে আরও কয়েকবার।
কথার সূত্র ধরে এক পর্যায়ে হয় পরিচয়। বাড়তে থাকে ঘনিষ্ঠতা। সেখান থেকে ভালো লাগা। ভালোবাসা। ভালোবাসা গড়ায় অবৈধ সম্পর্কে। এক সময় অবৈধ মেলামেশার দৃশ্য ধারণ হয় মোবাইলে, ল্যাপটপে। এক সময় মেয়েটি সরে দাঁড়ানোর চিন্তা করে। এ কথা বলতেই চেহারা পাল্টে যায় বাচ্চুর।
সম্পর্কের কয়েক বছর পর বাচ্চু তার প্রেমিকাকে সোনার ডিম পাড়া হাঁস হিসেবেই ভাবত। ক্ষুব্ধ বাচ্চু ভালোবাসার ইতি ঘটিয়ে সম্পর্ক গড়ায় ব্লাকমেইল পর্যায়ে।
মিষ্টি ভাবে, কেন এমন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল। নিজের ওপর রাগ ঘৃণা সব হয় তার। মাঝে মধ্যে আত্মহত্যা করবে বলেও ভেবেছে। পারেনি সন্তানের দিকে তাকিয়ে।
কিন্তু হঠাৎ সেই বাচ্চুর লাশ পাওয়া যায় তার নিজ বাসা দক্ষিণ কাফরুলের ফ্লাট থেকে। ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর হাত-পা বাঁধা ও জবাই করা অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কিন্তু পুলিশ এই খুনের কোনো ক্লু খুঁজে পায় না। উদ্ঘাটন হয় না খুনের রহস্য।
তবে পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল বিভিন্ন সূত্রে। ঘটনার ১৪ মাস পর ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোয়েন্দারা গ্রেফতার করে মিষ্টিকে। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় বাচ্চুর সঙ্গে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের দৃশ্য সংবলিত ল্যাপটপ, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মিষ্টির একটি ওড়না এবং একটি মোবাইল ফোন।
মেয়েটি স্বীকার করে খুনের ঘটনায় সে জড়িত। সে বলেছে, ‘পাঁচ বছরের সম্পর্কের প্রথম তিন বছর ভালো কেটেছে তাদের। এরপর থেকেই ব্লাকমেইল করতে থাকে বাচ্চু।
অতিষ্ঠ হয়ে সংসার বাঁচাতে তাকে খুন করার পরিকল্পনা করি। কিন্তু কাউকে ভাড়া করলে সাক্ষী থেকে যাবে। তাই অনেক চিন্তা করে তাকে নিজেই খুনের পরিকল্পনা করি।
সেভাবে ফাঁদ পাতি। তার বাসাতেই মিলিত হওয়ার কথা বলি বাচ্চুকে। বাচ্চু রাজি হয়। তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সময় বাচ্চু যখন প্রচণ্ড আবেগে ছিল, ঠিক তখনই তার বুকে ছোরা বসিয়ে হত্যা করি। সব পরিষ্কার করে সেখান থেকে পালিয়ে আসি।’
সংশ্লিষ্টরা বলছে, ঘটনার পর অনুশোচনায় ভোগে মেয়েটি। তার বক্তব্য ছিল, স্বামী সংসার ছেড়ে এভাবে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াটা তার ঠিক হয়নি। আর কেউ যেন এমন সম্পর্কে না জড়িয়ে পড়ে। তাতে করে এমন খারাপ কিছু হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনৈতিক সম্পর্কগুলো এভাবেই এক সময়ে খারাপের দিকে যায়। কখনো কখনো এমন নৃশংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এ কারণে প্রত্যেককেই সজাগ থাকতে হবে।
এ ঘটনায় দুটি পরিবার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। বাচ্চুর সন্তান বাবা হারিয়েছে। স্ত্রী হারিয়েছে স্বামীকে। অন্যদিকে খুনের বিচার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। মিষ্টিও হারিয়েছে সব।