শুক্রবার, ১৯শে অক্টোবর, ২০১৮ ইং ৪ঠা কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

বুকের উপর হাত বাঁধার হাদীস : একটু পর্যালোচনা

যেসব হাদীস দ্বারা বুকের উপর হাত বাঁধার প্রমাণ পেশ করা হয়, তার একটিও সহীহ নয়। নিম্নে পর্যালোচনাসহ হাদীসগুলো তুলে ধরা হলো।


হযরত ওয়াইল রা. বলেছেন,
صليت مع رسول الله صلى الله عليه و سلم ووضع يده اليمنى على يده اليسرى على صدره

আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামায পড়লাম। তিনি তার ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর রাখলেন।

আলবানী সাহেব হাদীসটি সম্পর্কে সহীহ ইবনে খুযায়মার টীকায় মন্তব্য করেছেন:
إسناده ضعيف لأن مؤملا وهو ابن اسماعيل سيئ الحفظ لكن الحديث صحيح جاء من طرق أخرى بمعناه وفي الوضع على الصدر أحاديث تشهد له

অর্থাৎ ‘এর সনদ দুর্বল। কেননা মুয়াম্মাল: তিনি ইসমাঈলের পুত্র: দুর্বল স্মৃতিশক্তির অধিকারী। তবে সমার্থক অন্যান্য সূত্রে বর্ণিত হওয়ায় হাদীসটি সহীহ। আর বুকের উপর হাত রাখার ক্ষেত্রে অনেক হাদীস রয়েছে, যা এর সমর্থন করে। সহীহ ইবনে খুযায়মা, ১/২৪৩ হাদীস নং ৪৭৯; আবুশ শায়খ, তাবাকাতুল মুহাদ্দিসীন বিআসবাহান, ২/২৮৬; বায়হাকী ২/৩০, হাদীস নং ২৩৩৬।’

কিন্তু এ হাদীসটি সহীহ নয়। কারণ:

এর সনদে মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল আছেন। তিনি সুফিয়ান ছাওরী থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। মুয়াম্মালকে ইমাম বুখারী মুনকারুল হাদীস বলেছেন। তিনি একথাও বলেছেন, আমি যাকে মুনকারুল হাদীস বলবো, তার সূত্রে বর্ণনা করা বৈধ হবে না। তাছাড়া ইবনে সা’দ বলেছেন, ثقة كثير الغلط তিনি বিশ্বস্ত, তবে অনেক ভুল করতেন। আবূ যুরআ রাযী বলেছেন, في حديثه خطأ كثير তার হাদীসে অনেক ভুল; আবূ হাতেম রাযী বলেছেন, صدوق كثير الخطأ يكتب حديثه তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠ, তবে প্রচুর ভুল করতেন, তার হাদীস লিপিবদ্ধ করা যায়। (আল জারহু ওয়াত তাদীল, ৮/৩৭৪) দারাকুতনী বলেছেন, ثقة كثير الخطأ তিনি বিশ্বস্ত তবে অত্যধিক ভুলের শিকার। ইবনে মাঈন এক বর্ণনায় বলেছেন, সুফিয়ানের ক্ষেত্রে তিনি প্রমাণযোগ্য হওয়ার উপযুক্ত নন। (দ্র. তারীখে ইবনে মুহরিয, ১/১১৪) মুহাম্মদ ইবনে নসর বলেছেন, তিনি কোন বর্ণনার ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ হলে ভেবে চিন্তে দেখতে হবে, কেননা তিনি প্রচুর ভুলের শিকার ছিলেন। (দ্র. তাহযীবুত তাহযীব)

ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান আল ফাসাবী উল্লেখ করেছেন যে, সুলায়মান ইবনে হারব বলেছেন, وقد يجب على أهل العلم أن يقفوا عن حديثه ويتخففوا من الرواية عنه فإنه منكر يروي المناكير عن ثقات شيوخنا وهذا أشد فلو كانت هذه المناكير عن ضعاف لكنا نجعله له عذرا আলেমগণের উচিৎ, তার হাদীস গ্রহণ করার ব্যাপারে সতর্ক থাকা ও কম করে বর্ণনা করা। কারণ তিনি আপত্তিকর হাদীস বর্ণনা করতেন আমাদের বিশ্বস্ত উস্তাদগণ থেকে। এটা খুবই অন্যায়। কারণ এসব আপত্তিকর বর্ণনা যদি দুর্বলদের থেকে হতো তবে আমরা তাকে মাযুর বিবেচনা করতাম। (আল মারিফা ওয়াত তারীখ, ৩/৫২)

আস সাজী বলেছেন, صدوق كثير الخطأ وله أوهام يطول ذكرها তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠ, তবে প্রচুর ভুলের শিকার, সেগুলোর পরিমাণ এত বেশী যে,উল্লেখ করলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে। (তাহযীবুত তাহযীব)

ইবনে হাজার আসকালানীও ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেন, وكذلك مؤمل بن إسماعيل في حديثه عن الثوري ضعف অর্থাৎ একইভাবে (সুফিয়ান) ছাওরী হতে মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈলের বর্ণনায় দুর্বলতা আছে। (দ্র, ৯খ, ২৮৮পৃ, ৫১৭২ হাদীসের অধীনে)

তাছাড়া স্বয়ং আলবানী র.ও মুয়াম্মাল কর্তৃক বর্ণিত সহীহ ইবনে খুযায়মার দুটি হাদীসকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। হাদীস দুটির নম্বর হলো ১১০৫ ও ১১৩৬।


মুয়াম্মালের দুজন সঙ্গী মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ ফিরয়াবী (আলমুজামুল কাবীর তাবারানী ২২/৩৩) ও আব্দুল্লাহ ইবনুল ওয়ালিদ (মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৮; নাসাঈ, হাদীস নং ৮৮৯) (দুজনই বিশ্বস্ত রাবী) সুফিয়ান রহ.থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাদের বর্ণনায় ‘বুকের উপর’ কথাটি নেই।


আলবানী সাহেব আবুশ শায়খের উদ্ধৃতি তো দিয়েছেন। কিন্তু তার বর্ণনাটি পেশ করেন নি। অথচ উক্ত বর্ণনায় আছে, رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم وضع يده على شماله عند صدره. অর্থাৎ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলাম, তিনি ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে বুকের কাছে রাখলেন।

এ হাদীসের সনদেও মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল আছেন। তাহলে তার বর্ণনায় ইযতিরাব বা অসংগতি পাওয়া গেল। কখনও বলেছেন বুকের উপর, কখনও বুকের কাছে।


এ হাদীসটি মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাঈল সুফিয়ান সাওরী থেকে বর্ণনা করেছেন, অথচ সুফিয়ান সাওরী রহ. নিজেই নাভীর নীচে হাত বাঁধতেন।

মুয়াম্মালের সূত্র ছাড়া এ হাদীসের আরেকটি সুত্র রয়েছে। সেটি হলো:
عن محمد بن حجر بن عبد الجبار بن وائل الحضرمي حدثني عمي سعيد بن عبد الجبار عن أبيه عن أمه أم يحيى عن وائل بن حجر وفيه: ثم وضع يمينه على يساره على صدره. أخرجه الطبراني في الكبير ২২/৪২ (১১৮) والبيهقي (২৩৩৫)

অর্থাৎ মুহাম্মদ ইবনে হুজর তার চাচা সাঈদ ইবনে আব্দুল জাব্বার থেকে, তিনি তার পিতা আব্দুল জাব্বার ইবনে ওয়াইল থেকে, তিনি তার মাতার সুত্রে ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর রাখলেন। (তাবারানী, মুজামে কাবীর, ২২/৪২ হাদীস ১১৮; বায়হাকী, হাদীস ২৩৩৫)

এ সুত্রটিও দুর্বল। তার কারণ:


মুহাম্মদ ইবনে হুজর দুর্বল। তার সম্পর্কে ইমাম বুখারী র. বলেছেন, فيه نظر অর্থাৎ তার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। (তারীখে কাবীর, নং ১৬৪) আবু আহমদ আল হাকেম বলেছেন, ليس بالقوي عندهم অর্থাৎ তিনি মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে শক্তিশালী বর্ণনাকারী নন। (লিসান, ৭/৫৮)

আর ইবনে হিব্বান তার আলমাজরূহীন (সমালোচিত রাবী চরিত) গ্রন্থে বলেছেন,
يروي عن عمه سعيد بن عبد الجبار عن أبيه عبد الجبار عن أبيه وائل بن حجر بنسخة منكرة منها أشياء لها أصول من حديث رسول الله صلى الله عليه و سلم وليست من حديث وائل بن حجر ومنها أشياء من حديث وائل بن حجر مختصرة جاء بها على التقصي وأفرط فيها ومنها أشياء موضوعة ليس من كلام رسول الله صلى الله عليه و سلم لا يجوز الاحتجاج به

অর্থাৎ ‘মুহাম্মদ ইবনে হুজর তার চাচা সাঈদ ইবনে আব্দুল জাব্বার থেকে, তিনি তার পিতা আব্দুল জাব্বার থেকে, তিনি তার পিতা ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে: এই সূত্রে বর্ণিত আপত্তিকর একটি হাদীসের কপি থেকে হাদীস বর্ণনা করে থাকেন। এর মধ্যে কিছু হাদীস এমন আছে, যার মূল তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু তা ওয়াইল রা. কর্তৃক বর্ণিত নয়। আর কিছু হাদীস এমন আছে, যা হযরত ওয়াইল রা. থেকে সংক্ষিপ্তরূপে বর্ণিত আছে। কিন্তু মুহাম্মদ ইবনে হুজর তাতে বৃদ্ধি ঘটিয়ে বিস্তারিতরূপে পেশ করেছেন। আবার কিছু হাদীস আছে সম্পূর্ণ জাল। সেগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। তাকে (মুহাম্মদ ইবনে হুজরকে) প্রমাণস্বরূপ পেশ করা ঠিক হবে না।’

উকায়লী ও ইবনে আদীও তার ব্যাপারে ইমাম বুখারীর মন্তব্য উল্লেখ করে সমর্থন করেছেন। যাহাবী মীযান ও মুগনী উভয় গ্রন্থে বলেছেন, له مناكير অর্থাৎ তার কিছু কিছু আপত্তিকর বর্ণনা রয়েছে। আর আল মুকতানা ফী সারদিল কুনা গ্রন্থে তিনি বলেছেন ليّن অর্থাৎ দুর্বল। হায়সামী বলেছেন, وهو ضعيف অর্থাৎ তিনি দুর্বল। (মাজমাউয যাওয়াইদ, ১১৭৮ ও ১৬০০৪)

মুহাম্মদ ইবনে হুজরের চাচা সাঈদ ইবনে আব্দুল জাব্বারও সমালোচিত রাবী। তার সম্পর্কে ইমাম বুখারী বলেছেন, فيه نظر অর্থাৎ তার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। ইবনে মাঈন বলেছেন, لم يكن بثقة অর্থাৎ তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন না।


সাঈদ ইবনে আব্দুল জাব্বারের তিনজন সঙ্গী আছেন। এক. মুহাম্মদ ইবনে জুহাদা (মুসলিম, নং ৪০১), দুই. আবু ইসহাক আস সাবিঈ (আহমদ, ৪/৩১৮) তিন. আলমাসউদী (আহমদ, নং ১৮৮৫২; তাবারানী, ২২/৩২-৩৩)। কিন্তু তাদের কারো বর্ণনাতেও বুকের উপর কথাটি নেই।

সুতরাং এটি যে মুহাম্মদ ইবনে হুজরের ভুল বর্ণনা সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া বাযযার র. তার মুসনাদে একই সনদে এই হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। সেখানে বুকের উপর কথাটির পরিবর্তে আছে: عند صدره অর্থাৎ বুকের কাছে। (দ্র, বাযযার, ৪৪৮৮)।

সনদের দুর্বলতার পাশাপাশি এটা মতনের ইযতিরাবও বটে।

বোঝা গেল, হাদীসটির কোন সনদই সহীহ নয়। সুতরাং ‘তবে সমার্থক অন্যান্য সূত্রে বর্ণিত হওয়ায় হাদীসটি সহীহ’ আলবানী সাহেবের একথাও সঠিক নয়। এর সমর্থক বর্ণনাগুলোও দুর্বল, যেমনটি সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।


তাউসের বর্ণনাটি আবূ দাউদ (৭৫৯) শরীফে আছে। হাদীসটি নিম্নরূপ:
عَنْ طَاوُسٍ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَضَعُ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى يَدِهِ الْيُسْرَى ثُمَّ يَشُدُّ بَيْنَهُمَا عَلَى صَدْرِهِ وَهُوَ فِى الصَّلاَةِ.

অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতেন। অতঃপর উভয় হাত বুকের উপর বাঁধতেন।

এটি মুরসাল। আর মুরসাল (সূত্র বিচ্ছিন্ন) কে তারা প্রামাণ্য মনে করেন না। তদুপরি এতে সুলায়মান ইবনে মূসা নামের একজন বর্ণনাকারী আছেন। তার সম্পর্কে বুখারী র. বলেছেন, عنده مناكير তার কিছু আপত্তিকর বর্ণনা আছে। ইমাম নাসাঈ বলেছেন, ليس بالقوي في الحديث তিনি হাদীসে মজবুত নন। ( দ্র, যাহাবীর আল কাশিফ)

আলী ইবনুল মাদীনী বলেছেন, مطعون عليه সমালোচিত ও অভিযুক্ত রাবী। আস সাজী রহ. বলেছেন, عنده مناكير তার কিছু আপত্তিকর বর্ণনা আছে।

হাকেম আবু আহমদ বলেছেন, في حديثه بعض المناكير তার হাদীসে কিছু কিছু আপত্তিকর বিষয় আছে।

আবু হাতেম রাযী বলেছেন, محله الصدق وفي حديثه بعض الاضطراب তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠ মানের, তবে তার হাদীসে কিছু কিছু ইযতিরাব বা অসঙ্গতি রয়েছে। ইবনুল জারূদ তাকে যুআফা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

বোঝা যায়, তার দৃষ্টিতেও তিনি দুর্বল ছিলেন। ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তাকরীব গ্রন্থে লিখেছেন,
صدوق فقيه في حديثه بعض لين وخولط قبل موته بقليل

তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠ, ফকীহ, তার হাদীসে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে তার হাদীস ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল।
এখন বলুন, এ ধরনের বর্ণনাকারীর হাদীস সহীহ হয় কীভাবে? স্বয়ং আলবানী সাহেব তার সম্পর্কে আসলু সিফাতিস সালাহ গ্রন্থে (২/৫২৮) লিখেছেন, صدوق في حديثه بعض لين সাদূক, তার হাদীসে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আর ইরওয়া গ্রন্থে (৬/২৪৬)

একটি হাদীস সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন,
إن الحديث رجاله كلهم ثقات رجال مسلم إلا أن سليمان بن موسى مع جلالته في الفقه فقد قال الذهبي في الضعفاء : صدوق )ثم قال بعد ذكر قول البخاري والحافظ في التقريب( وعلى هذا فالحديث حسن الإسناد وأما الصحة فهي بعيدة عنه.

অর্থাৎ ‘এ হাদীসটির রাবীগণ সকলে বিশ্বস্ত, মুসলিমের রাবী। তবে সুলায়মান ইবনে মূসা ফিকহে উচ্চ মানসম্পন্ন ব্যক্তি হলেও যাহাবী তার সম্পর্কে স্বীয় যুআফা গ্রন্থে বলেছেন, সাদূক।

এরপর আলবানী সাহেব ইমাম বুখারী ও তাকরীব গ্রন্থে হাফেয ইবনে হাজার এর মন্তব্য উল্লেখপূর্বক বলেছেন, এ হিসাবে হাদীসটি হাসান স্তরের সনদ বিশিষ্ট। এটি কোনভাবেই সহীহ হতে পারে না।

সারকথা,
অনেক মুহাদ্দিসের দৃষ্টিতে সুলায়মানের দুর্বলতার কারণে হাদীসটি দুর্বল। হ্যাঁ, কিছু কিছু আলেমের দৃষ্টিতে এটি বড়জোর হাসান মানসম্পন্ন, সহীহ নয়। তৎসঙ্গে মুরসাল হওয়াও একটি সমস্যা। সালাফ বা পূর্বসূরিগণের আমল এ অনুযায়ী না থাকা আরো বড় সমস্যা। আরেকটি সমস্যা হলো, সুলায়মান ইবনে মূসা মুদাল্লিস রাবী। যেমনটি বলেছেন ইবনে হিব্বান তার মাশাহীরু উলামাইল আমসার গ্রন্থে। ইবনে হাজার আসকালানীও তাকে মুদাল্লিস রাবীদের তালিকামূলক গ্রন্থ তা’রীফু আহলিত তাকদীস বি মারাতিবিল মাওসূফীনা বিত তাদলীসে উল্লেখ করেছেন। আর স্বীকৃত কথা যে, মুদাল্লিস রাবী যদি عن (হতে বা থেকে) শব্দ যোগে বর্ণনা করেন, তবে সেটি অবিচ্ছিন্ন সূত্র বলে বিবেচিত হয় না। এ হিসাবে সুলায়মান ও তাউসের মাঝে আরেকটি বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হচ্ছে। যার কারণে হাদীসটি হাসান হওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়ছে।


হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর একটি হাদীস বায়হাকীতে আছে। হাদীসটি এমন:
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُمَا فِى قَوْلِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ ( فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ) قَالَ : وَضْعُ الْيَمِينِ عَلَى الشِّمَالِ فِى الصَّلاَةِ عِنْدَ النَّحْرِ.

অর্থাৎ আল্লাহর বাণী : فصل لربك وانحر সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, নামাযে বাম হাতের উপর ডান হাত রেখে গলার কাছে রাখা।

এ হাদীসের সনদে রাওহ্ ইবনুল মুসায়্যাব আছে, তিনি চরম দুর্বল রাবী। ইবনে হিব্বান তার সম্পর্কে বলেছেন, তিনি বিশ্বস্ত লোকদের নামে জাল হাদীস বর্ণনা করতেন, তার থেকে হাদীস গ্রহণ করা বৈধ হবে না। ইবনে আদী বলেছেন, أحاديثه غير محفوظة তার হাদীস সঠিক নয়। (দ্র, তাহযীবুত তাহযীব)

তাছাড়া এতে ইয়াহইয়া ইবনে আবু তালিব আছেন। তিনি বিতর্কিত বর্ণনাকারী। হাদীসটি দুর্বল হওয়ার আরেকটি কারণ হলো: একই আয়াতের ব্যাখ্যায় আলী রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে বুকের উপর হাত বাঁধার কথা।

এসব দুর্বলতার কারণেই শাওকানী সাহেব লা-মাযহাবী হওয়া সত্ত্বেও তার তাফসীর ফাতহুল কাদীরে আলী রা. ও ইবনে আব্বাস রা.এর কোন হাদীসই উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় উদ্ধৃত করেন নি।

হাফেজ ইবনে কাছীর রহ. আলী রা.এর ব্যাখ্যাটি উল্লেখপূর্বক বলেছেন, ولا يصح এটি সহীহ নয়। এ মর্মে আরো কিছু ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করে তিনি মন্তব্য করেছেন: وكل هذه الأقوال غريبة جدا والصحيح القول الأول এসব বক্তব্য অত্যন্ত অপরিচিত ও অভিনব।

প্রথম ব্যাখ্যাটিই সহীহ ও সঠিক। আর প্রথম ব্যাখ্যাটি তিনি এভাবে পেশ করেছেন:
قال ابن عباس، وعطاء، ومجاهد، وعكرمة، والحسن: يعني بذلك نحر البُدْن ونحوها. وكذا قال قتادة، ومحمد بن كعب القرظي، والضحاك، والربيع، وعطاء الخراساني، والحكم، وإسماعيل بن أبي خالد، وغير واحد من السلف

অর্থাৎ ইবনে আব্বাস রা. আতা, মুজাহিদ, ইকরিমা, ও হাসান (বসরী) বলেছেন, আয়াতের মর্ম হলো, উট বা অন্য পশু কুরবানী করা। একই কথা বলেছেন কাতাদা মুহাম্মদ ইবনে কাব আলকুরাজী, দাহহাক, আর রাবী’, আতা আলখুরাসানী, হাকাম, ইসমাঈল ইবনে আবু খালিদ ও অনেক পূর্বসূরি। (দ্র. সূরা কাওছার এর তাফসীর)

আয়াতটির উক্ত সহীহ ব্যাখ্যাই অবলম্বন করেছেন আরবের বিখ্যাত আলেম লা-মাযহাবী ঘরানার লোক বাক্র আবু যায়দ। তিনিও হযরত ইবনে আব্বাস রা. কর্তৃক বর্ণিত গলার নিকট হাত বাঁধার হাদীসটিকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। এবং হযরত আলী রা. কর্তৃক বর্ণিত এ হাদীসটি সম্পর্কে ইবনে কাছীর রহ.এর পূর্বোক্ত মন্তব্যকেই সমর্থন করেছেন। (দ্র. মাজমূআ রাসাইল, লা-জাদীদা ফী আহকামিস সালাত, পৃ. ১২, ১৫)

শুধু তাই নয়, লা-মাযহাবী বন্ধুদের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ কুরআনের উর্দু অনুবাদ যা সৌদি সরকারের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও আয়াতটির অর্থ লেখা হয়েছে اور قربانى كر এবং কুরবানী কর। এমনিভাবে ড. মুজিবুর রহমান, সদস্য বাংলাদেশ জামইয়তে আহলে হাদীস, তাঁর বাংলা কুরআন তরজমায় এর অর্থ লিখেছেন, এবং কুরবানী কর।

হযরত আলী রা. ও ইবনে আব্বাস রা. এর হাদীস দুটি সহীহ হলে এসব লা-মাযহাবী আলেম আয়াতটির এমন অনুবাদ করলেন কিভাবে?


হযরত আলী রা. এর একটি হাদীস বুখারী র. এর তারীখে কাবীরে আছে। হাদীসটি হলো :
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ ظَبْيَانَ عَنْ عَلِىٍّ (فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ) وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى وَسْطِ سَاعِدِهِ عَلَى صَدْرِهِ. (رقم:২৯১১)

উকবা ইবনে জাবয়ান হযরত আলী রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, فصل لربك وانحر (আয়াতের ইনহার শব্দের অর্থ হলো) ডান হাত বাম হাতের বাহুর মাঝ বরাবর রেখে বুকের উপর রাখা। (দ্র. নং ২৯১১)

তিনটি কারণে এ হাদীসটিও সহীহ নয় :

এক,
হযরত আলী রা. থেকে যিনি এটি বর্ণনা করেছেন, তার নাম নিয়ে বর্ণনাকারীগণ বিভিন্ন কথা বলেছেন। ইয়াযীদ ইবনে যিয়াদ ইবনে আবুল জা’দ তার নাম বলেছেন উকবা ইবনে যুহায়র (عقبة بن ظهير), হাম্মাদ ইবনে সালামা তার নাম বলেছেন উকবা ইবনে যাবয়ান (عقبة بن ظبيان), আর আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী র. বলেছেন, উকবা ইবনে সাহবান(عقبة بن صهبان)। আবার উকবা থেকে এটি কে বর্ণনা করেছেন তা নিয়েও এযতেরাব আছে। ইয়াযীদ ইবনে যিয়াদ বলেছেন আসিম আল জাহদারীর নাম। কিন্তু হাম্মাদ ইবনে সালামা বলেছেন আসিমের পিতার নাম। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় এটাকে সনদের এযতেরাব বলা হয়, যা হাদীস দুর্বল প্রমাণিত হওয়ার অন্যতম কারণ। দ্র, ইলালে দারাকুতনী, ৪খ, ৯৯পৃ; আল জারহু ওয়াত তা’দীল লি ইবনে আবী হাতিম, ৬খ, ৩১৩পৃ।

দুই,
হযরত আলী রা. থেকে এ হাদীসটি একই সনদে ইবনে আবী হাতেম আল জারহু ওয়াত তা’দীল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সেখানে নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখার কথা আছে, ‘বুকের উপর’ (على الصدر) কথাটি নেই। একইভাবে ইবনে আবী শায়বাও মুসান্নাফে এটি উল্লেখ করেছেন, সেখানেও বুকের উপর কথাটি নেই। দ্র, হাদীস নং ৩৯৬২।

তিন,
ইমাম বুখারী র. তার আত তারীখুল কাবীর গ্রন্থে উক্ত হাদীসকে সমর্থন করেননি, বরং সেটি উল্লেখ করার পর বলেছেন,
وقال قتيبة عن حميد بن عبد الرحمن عن يزيد بن أبي الجعد عن عاصم الجحدري عن عقبة من أصحاب علي عن علي رضـ : وضعها على الكرسوع. ٦/٤٣٧

অর্থাৎ কুতায়বা র. হুমায়দ ইবনে আব্দুর রহমানের সূত্রে ইয়াযীদ ইবনে আবুল জা’দ থেকে, তিনি আসিম জাহদারীর সূত্রে হযরত আলী রা. এর ছাত্র উকবা থেকে, তিনি হযরত আলী রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি তার হাত কব্জির উপর রাখলেন। (দ্র, ৬খ, ৪৩৭পৃ)

এতে বোঝা যায়, তিনি এই দ্বিতীয় বর্ণনাটিকে সঠিক মনে করেছেন। এতে করে এই বর্ণনাটিও হানাফী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের দলিলরূপে গণ্য হবে। বুখারী শরীফে বর্ণিত আলী রা.এর আমলটি এই দ্বিতীয় বর্ণনারই সমর্থক।


হযরত হুলব রা. থেকে বর্ণিত:
وَرَأَيْتُهُ ، قَالَ ، يَضَعُ هَذِهِ عَلَى صَدْرِهِ وَصَفَ يَحْيَى : الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى فَوْقَ الْمِفْصَلِ.

অর্থাৎ আর আমি তাঁকে (নবী সা.কে) দেখলাম, এটি বুকের উপর রাখতে। ইয়াহইয়া (ইবনে সাঈদ আল কাত্তান) এর বিবরণ দিয়েছেন: ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর।

হাদীসটি মুসনাদে আহমদে (২২৩১৩) আছে। সুফিয়ান থেকে শধু ইয়াহয়াই বুকের উপর হাত বাঁধার কথাটি উল্লেখ করেছেন। মুসনাদে আহমদে ওয়াকী র., দারাকুতনীতে ওয়াকী ও আব্দুর রহমান ইবনে মাহদীও বায়হাকীতে (৩৬১০) আল হুসাইন ইবনে হাফস তিনজন সুফিয়ান থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাদের বর্ণনায় বুকের উপর হাত বাঁধার কথা নেই। তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমদে সুফিয়ানের সঙ্গী আবুল আহওয়াস ও মুসনাদে আহমদে ৫/২২৬ (নং ২২৩১৬)

শরীক ইবনে আব্দুল্লাহ উস্তাদ ‘সিমাক’ থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনাতেও বুকের উপর হাত বাঁধার কথা নেই। সুতরাং এটি শায বা দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা, যা গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষভাবে আব্দুর রহমান ইবনে মাহদীর বর্ণনাটি এজন্য অগ্রগণ্য হওয়ার উপযুক্ত যে, ইমাম আহমদ বলেছেন, كان يحب أن يحدث باللفظ অর্থাৎ তিনি উস্তাদের মূল শব্দে বর্ণনা করা পছন্দ করতেন।

আর আবূ হাতেম রাযী বলেছেন, هو أثبت من يحيى بن سعيد وأتقن من وكيع وكان يعرض حديثه على الثورى অর্থাৎ তিনি ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদের তুলনায় সুদৃঢ়, ওয়াকীর চেয়ে মজবুত। তিনি সুফিয়ান ছাওরীর হাদীসগুলো তাঁর সামনে পেশ করে শোনাতেন।

তাছাড়া সুফিয়ান ছাওরী রহ. যদি এটি এভাবে বর্ণনা করে থাকেন, তবে তার আমলও এ অনুযায়ী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আমল হলো নাভীর নীচে হাত বাঁধা। (দ্র. আত তামহীদ, ২০/৭৫) বোঝা গেল, তিনি হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেন নি।

আল্লামা নিমাবী র. আছারুস সুনান গ্রন্থে লিখেছেন,
ويقع في قلبي أن هذا تصحيف من الكاتب والصحيح يضع هذه على هذه فيناسبه قوله: وصف يحيى اليمنى على اليسرى فوق المفصل ويوافقه سائر الروايات

অর্থাৎ আমার মনে হয়, অনুলেখকের ভুলের কারণে এমনটি হয়েছে। সঠিক হবেعلى صدره (বুকের উপর) এর স্থলে على هذه (এই হাতের উপর)। (এ হিসেবে হাদীসটির অর্থ দাঁড়ায়- এই হাতটি এই হাতের উপর রেখেছেন: লেখক)। এতে এটি পরের কথার সঙ্গেও মিলে যায়। কারণ পরে বলা হয়েছে, ইয়াহইয়া ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রেখে দেখিয়েছেন। আর এটি তখন অন্যান্য বর্ণনাকারীদের বর্ণনার সাথেও সংগতিপূর্ণ হয়। (দ্র, পৃ ৮৭)

উল্লেখ্য যে, ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ থেকে এ বর্ণনাটি তার শিষ্যদের মধ্যে শুধু ইমাম আহমদই উদ্ধৃত করেছেন। এতে যদি বুকের উপর হাত রাখার কথা থাকত, তাহলে ইমাম আহমদ এটাকে মাকরুহ বলতেন না।

অথচ হাদীসটি শোনার পর তিনি ঐ মাকরুহ হওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন। তার প্রমাণ, ইমাম আবু দাউদ জন্ম লাভ করেছেন ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদের মৃত্যুর পর। আর তিনি ইমাম আহমদ থেকে নিজের শোনা মাসায়েলের যে সংকলন তৈরি করেছেন, তাতে উল্লেখ রয়েছে: وسمعته سئل عن وضعه فقال فوق السرة قليلا، وإن كان تحت السرة فلا بأس وسمعته يقول يكره أن يكون يعني وضع اليدين عند الصدر অর্থাৎ আমি শুনেছি, তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, হাত কোথায় রাখা হবে? তিনি বললেন, নাভির সামান্য উপরে। নাভির নীচে রাখলেও কোন অসুবিধা নেই। আমি তাকে এ কথাও বলতে শুনেছি যে, এভাবে অর্থাৎ বুকের কাছে হাত রাখা মাকরুহ।

স্বয়ং লা-মাযহাবী বন্ধুরাও এ হাদীসের উপর আমল করেন না। কারণ এর শেষাংশে বলা হয়েছে: অতঃপর ইয়াহয়া ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রাখেন। এই ইয়াহয়া হলেন ইবনে সাঈদ আল কাত্তান। তিনি হাদীসটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রেখে বুঝিয়ে দিয়েছেন, হাত কিভাবে বাঁধতে হয়।

ইমাম তিরমিযীর যুগ পর্যন্ত বুকে হাত বাঁধার প্রচলন ছিল না

ইমাম তিরমিযী র. হযরত হুলব রা. এর হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন,
والعمل على هذا عند أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم والتابعين ومن بعدهم يرون أن يضع الرجل يمينه على شماله في الصلاة ورأى بعضهم أن يضعهما فوق السرة ورأى بعضهم أن يضعهما تحت السرة وكل ذلك واسع عندهم

অর্থাৎ সাহাবী, তাবেয়ী ও পরবর্তী যুগের আলেমগণের আমল ছিল এ হাদীস অনুযায়ী। তাঁরা মনে করতেন, নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখবে। তাঁদের কেউ কেউ মনে করতেন নাভির উপরে রাখবে, আর কেউ কেউ মনে করতেন নাভির নীচে রাখবে। তাঁদের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটিরই অবকাশ আছে।

লক্ষ করুন, সাহাবী, তাবেয়ী ও তিরমিযী র.এর যুগ পর্যন্ত আলেমগণকে তিনি দুভাগ করেছেন। এক ভাগের মত ছিল নাভির নীচে হাত বাঁধা, আরেক ভাগের মত ছিল নাভির উপরে হাত বাঁধা। বুকের উপর হাত বাঁধার আমল কোথায়? একইভাবে ইবনুল মুনযির র.ও তাঁর আল আওসাত গ্রন্থে উপরোক্ত দুই ধরনের আমল ও মতের কথাই উল্লেখ করেছেন।

বুকের উপর হাত বাঁধা যে পূর্বসূরিগণের আমল ছিল না তা আলবানী সাহেবের নিম্নোক্ত কথা থেকেও স্পষ্ট হয়। ইরওয়াউল গালীল গ্রন্থে তিনি বলেছেন,
وأسعد الناس بهذه السنة الصحيحة الإمام إسحاق ابن راهويه فقد ذكر المروزي في ( المسائل ): ( كان إسحاق يوتر بنا . . . ويرفع يديه في القنوت ويقنت قبل الركوع ويضع يديه على ثدييه أو تحت الثديين). )২/৭১)

অর্থাৎ এই সহীহ সুন্নতটির উপর আমল করে সর্বাধিক ধন্য হয়েছিলেন ইমাম ইসহাক ইবনে রাহাওয়াই। মারওয়াযী তার মাসাইলে উল্লেখ করেছেন, ইসহাক র. আমাদেরকে নিয়ে বেতের পড়তেন। ৃৃ আর কুনুতে হাত তুলতেন। রুকুর পূর্বে কুনুত পড়তেন। এবং উভয় হাত বুকের উপর বা বুকের নীচে রাখতেন। (ইরওয়া, ২/৭১)

এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, পূর্বসূরিগণের মধ্যে তিনি শুধু ইসহাক র.কেই এর উপর আমলকারী পেয়েছেন।

উল্লেখ্য যে, এই মারওয়াযী হলেন ইসহাক ইবনে মানসুর আল কাওসাজ। তারই রচিত ‘মাসাইলুল ইমাম আহমদ ওয়া ইসহাক’ গ্রন্থ থেকেই উদ্ধৃত অংশটুকু সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন আলবানী সাহেব। (দ্র. আলমাসাইল, নং ৩৫৪৬, ৩৫৪৭)

মারওয়াযীর এই গ্রন্থের বরাতেই আমরা ইসহাক র.এর এই বক্তব্য উল্লেখ করেছি যে নাভির নীচে হাত বাঁধার হাদীস অধিক শক্তিশালী ও বিনয়ের নিকটতর। (টীকা-১)

তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি নাভির নীচেই হাত বাঁধতেন। এ কারণে মাসাইলে ইমাম আহমাদ ও ইসহাক গ্রন্থটির টীকাকার বলেছেন, ‘আলবানীর উদ্ধৃত কথাটির অর্থ এই নয় যে, ইসহাক র. নামাযে বুকের উপর হাত বাঁধতেন। বরং এর অর্থ হলো, তিনি দোয়ায়ে কুনুত পড়ার সময় যে হাত ওঠাতেন তা বুক বরাবর বা বুকের নীচ পর্যন্ত ওঠাতেন।’ (দ্র. ৩৫৪৭ নং এর টীকা)

এ ব্যাখ্যাটি এজন্যও জরুরী যে, এতে দু’টি বক্তব্যের মধ্যে সুন্দরভাবে সমন্বয় সাধিত হয়। একটি হাদীসে এই ব্যাখ্যার সমর্থনও পাওয়া গেছে। হাদীসটি ইবনে আবূ শায়বা রহ. তার মুসান্নাফে উদ্ধৃত করেছেন। হাদীসটিতে হযরত আবূ হুরায়রা রা. তাকবীরে তাহরীমার সময় মানুষের হাত তোলার বিভিন্ন অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন,
منكم من يقول هكذا ورفع سفيان (بن عيينة) يديه حتى تجاوز بهما رأسه ومنكم من يقول هكذا ووضع يديه عند بطنه ومنكم من يقول هكذا يعني حذو منكبيه (رقم ২৪২২)

অর্থাৎ তোমাদের কেউ এমন করে, সুফিয়ান (ইবনে উয়ায়না) হাত তুলে মাথার উপর নিয়ে গিয়ে দেখালেন। আর কেউ এমন করে, সুফিয়ান পেট পর্যন্ত হাত তুললেন, আর কেউ এমন করে অর্থাৎ কাঁধ পর্যন্ত হাত তোলে। (হা. ২৪২২) এখানে وضع يديه عند بطنه পেট বরাবর হাত তোলার কথা বলা হয়েছে। হাত বাঁধার কথা বলা হয়নি। তেমনি ইসহাক রহ. সম্পর্কে যে বলা হয়েছে, ويضع يديه على ثدييه أو تحت الثديين এর অর্থ হবে, তিনি কুনুতের সময় উভয় হাত বুক বরাবর বা বুকের নীচ পর্যন্ত ওঠাতেন।

তাছাড়া ঐ উদ্ধৃতিতে ‘বুকের উপর রাখতেন’ শুধু এতটুকু বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, বুকের উপর বা নীচে রাখতেন। নীচে রাখলে তো আলবানী সাহেবের মতলব প্রমাণিত হয় না।

এটাও কম আশ্চর্যের নয় যে, আলবানী সাহেব ইসহাক র.এর ঐ স্পষ্ট বক্তব্যটি উল্লেখ না করে কুনুতে হাত বাঁধার: যা আসলে হাত তোলার: একটি অস্পষ্ট বক্তব্যের উদ্ধৃতি টেনেছেন।

উল্লেখ্য, হাত বাঁধার যে সহীহ নিয়ম পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি, সে নিয়মে হাত বাঁধলে বুকের উপর রাখা প্রায় অসম্ভব।

আরেকটি কথা, লা-মাযহাবী ভাইয়েরা যেভাবে হাত বাঁধেন, তাতে বুকের উপরে বাঁধা হয় না, হয় বুকের নীচে। আমি তাদের একজনকে বিষয়টি বলেছিলাম। তিনি আমার সামনে হাত বেঁধে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। শেষে বললেন, এটাতো কখনোই চিন্তা করিনি। আমি বললাম, এবার চিন্তা করুন। হাদীস বলবেন বুকের উপর হাত বাঁধার, আর আমল করবেন বুকের নীচে হাত বাঁধার, তা হয় না। সূত্র: আহলে হক মিডিয়া সার্ভিস