তিন সিটিতে আজ শেষ শোডাউন
বিশেষ প্রতিনিধি: রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণার শেষ দিন আজ (শনিবার)।তিন সিটিতে নির্বাচনী প্রচার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মধ্যরাতে।ভোটগ্রহণ শুরুর ৩২ ঘণ্টা আগে প্রচার কাজ বন্ধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে আইনে। ভোটে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে আজ থেকে মাঠে নামছেন বিজিবি-র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। চার দিনের জন্য মাঠে থাকবেন তারা।
চলতি বছরের শেষে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে তিন সিটির ভোট নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনৈতিক অঙ্গন। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে। এছাড়া এই নির্বাচন স্থানীয় নির্বাচন হলেও জনগণের দৃষ্টি এখন এই তিন সিটি নির্বাচন ঘিরে। চায়ের কাপে, আড্ডায় এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে এই মুহূর্তে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে তিন সিটি নির্বাচন। দেশবাসী এখন অপেক্ষায় রয়েছে তিন সিটি নির্বাচনের ফলাফলের দিকে। যার ফয়সালা হবে আগামী ৩০ জুলাই সোমবার।
প্রস্তুত তিন সিটি
রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঘিরে সাধরণ ভোটারদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উৎসাহ উদ্দীপনা। তবে শেষপর্যন্ত ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন কিনা এ নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে। নির্বাচন কমিশন অবশ্য ভোটারদের শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে পারবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। এরই মধ্যে তিন সিটিতেই জোরদার কার হয়েছে নিরাপত্তা। বসানো হয়েছে নিরাপত্তা চৌকি। শুক্রবার থেকে সিটি এলাকায় বহিরাগতদের অবস্থান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার দিকে সতর্ক চোখ রাখছে নির্বাচন কমিশন। সংসদ নির্বাচনের আগে তিন সিটি নির্বাচন যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে বিষয়ে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে সাংবিধানিক এই সংস্থাটি। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছে কমিশন। ভোট গ্রহণের দিন ভোটারদের কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রেও বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হবে।
সতর্ক নির্বাচন কমিশন
ইসির যুগ্ম সচিব ফরহাদ আহমদ খান বলেন, আজ মধ্যরাতে প্রচারণা বন্ধ হবে। আজ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে নামবেন। নির্বাচন সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন। ইসির কর্মকর্তারা বলেছেন, তিন সিটি নির্বাচনে জঙ্গি তত্পরতা ও গুজব রটানো রোধে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
তিনি জানান,তিন সিটিতেই নির্বাচন সামনে রেখে আজ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত মাঠে থাকবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, নির্বাহী-বিচারিক হাকিমসহ মোবাইল-স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ইসির চাহিদা অনুযায়ী রাখা হয়েছে। সাধারণ ভোট কেন্দ্রে ২২ জন ও গুরুত্বপূর্ণ ভোট কেন্দ্রে ২৪ জন নিরাপত্তা সদস্য মোতায়েন রাখা হবে। এ ছাড়া পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে প্রতিটি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে মোবাইল ফোর্স এবং প্রতিটি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে একটি করে স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে র্যাবের টিম এবং বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হবে। রাজশাহীতে ১৫ প্লাটুন, বরিশালে ১৫ প্লাটুন ও সিলেটে ১৪ প্লাটুন বিজিবি রাখা হবে। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ভোট কেন্দ্রের বাইরে র্যাব-পুলিশের টিম ও কয়েক প্লাটুন বিজিবি রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে থাকবে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ
নির্বাচন ঘিরে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক দলের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে। ঝড় উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনের লেবেল প্লেযিং ফিল্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বারবারই। তারা বলছেন প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশন যোগসাজশে সরকার দলীয় প্রার্থীর পক্ষ নিয়েছে। অপর দিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে নির্বাচনে জিততে পারবে না দেখেই বিএনপি নির্বাচন নিয়ে অবান্তর কথাবার্তা বলে চলেছে।
বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেছে। গত ২৩ জুলাই বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনে গিয়ে নির্বাচনে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ নিয়ে অভিযোগ দাখিল করে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানের নেতৃত্বে ওই প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে তিন সিটি নির্বাচনে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ ও ধানের শীষের প্রার্থীর প্রচারে বাধা দেয়া এবং তিন সিটিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার দাবিও দলটির পক্ষ থেকে তোলা হয়।
অপরদিকে ২৫ জুলাই তিন সিটির নির্বাচন বিষয়ে কথা বলতে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে দলের প্রধান এইচটি ইমান সাংবাদিকদের বলেন, অনেক সময় বিশেষ করে একটি দল কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় এমন বক্তব্য দেন। নির্বাচনকে ছোট করলে আমরা ছোট হই, জাতি ছোট হয়। তিনি বলেন তিন সিটি নির্বাচন খুলনা গাজীপুরের চেয়ে আরও ভাল নির্বাচন হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে দলের পক্ষ থেকে কমিশনকেও সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দেন তিনি।
শেষ সময়ের প্রচারণা
প্রচার-প্রচারণার শেষ সময়ে তিন সিটিতে বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করেই গণসংযোগ করেছেন প্রার্থীরা। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট প্রার্থনার পাশাপাশি নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। রাজশাহীতে প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করেই লক্ষ্মীপুর মোড় থেকে প্রচারণায় নামেন বিএনপি প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। জুমার নামাজ শেষে জাহাজঘাট এলাকায় গণসংযোগ করেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন। সিলেটের ছড়ারপাড়সহ কয়েকটি এলাকায় গণসংযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। আর বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী প্রচারণা চালান, কুমারপাড়া ও নয়াসড়ক এলাকায়।বরিশালে মেয়র প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। সকালে বরিশাল আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে মেয়র প্রার্থীদের সঙ্গে এ মতবিনিময় করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। ২৩ নম্বর শাহে জামে মসজিদে জুমার নামাজ শেষে প্রচারণায় নামেন বিএনপির প্রার্থী। আর বিকেলে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক দলের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গ উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টিতে ব্যর্থ হওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারী দলের অনিয়ম ও আচরণ লঙ্ঘনের অভিযোগ জানালে কমিশন বলে আমরা চেষ্টা করছি। চেষ্টা করা তো তাদের দায়িত্ব নয়। তাদের দায়িত্ব হলো নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পদক্ষেপ নেয়া। কমিশন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার নির্বাচনের নামে জনগণকে তামাশা দেখাচ্ছে। আসলে এখন এটি আর সিটি নির্বাচন নয়, তামাশা তামাশা আর তামাশায় পরিণত হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মী ও প্রার্থীর এজেন্টদের গ্রেফতার, হামলা নির্যাতন ও নারীদের সঙ্গে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে বলে অভিযোগ করেন।
অপরদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার শঙ্কা থেকে বিএনপি আগাম নানা অভিযোগ তুলছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই বিএনপির এমন বক্তব্যের জবাবে বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলতে ফখরুল কী বোঝাতে চান? ওবায়দুল কাদের কি কোন সিটি নির্বাচনের সময় কোন সিটির আশপাশেও গেছেন? ফখরুল ইসলাম সাহেব তো যেতে পারে। তাহলে এখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কোথায় থাকে? এক পার্টির সাধারণ সম্পাদক যেতে পারবে, আরেক পার্টির সাধারণ সম্পাদক যেতে পারবে না। তাহলে কি হেরে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন? সে জন্যই আগাম কিছু অভিযোগ রেখে যাচ্ছেন? যাতে হেরে গেলে এগুলোকে গ্রাউন্ড হিসেবে তুলে ধরতে পারেন উল্লেখ করেন।
তিন সিটির নির্বাচনী তথ্য
রাজশাহী সিটিতে মোট ভোটার ৩ লাখ ১৮ হাজার ১৩৮। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৫ ও মহিলা ১ লাখ ৬২ হাজার ৫৩। ভোট কেন্দ্র ১৩৮টি ও ভোট কক্ষ ১ হাজার ২৬টি। এ সিটিতে মোট মেয়র প্রার্থী ৫।
সিলেট সিটিতে মোট ভোটার ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৪৪ ও মহিলা ১ লাখ ৫০ হাজার ২৮৮। ভোট কেন্দ্র ১৩৪টি ও ভোট কক্ষ ৯২৬টি। এ সিটিতে মোট মেয়র প্রার্থী ৭।
বরিশাল সিটিতে মোট ভোটার ২ লাখ ৪২ হাজার ১৬৬। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ২১ হাজার ৪৩৬ ও মহিলা ১ লাখ ২০ হাজার ৭৩০। ভোট কেন্দ্র ১২৩টি ও ভোট কক্ষ ৭৫০টি। এ সিটিতে মোট মেয়র প্রার্থী ৬।