রক্তের টান: ৪০ বছর পর দুই বোন পেলেন আত্মপরিচয়
এমন ঘটনা সচরাচর সিনেমাতেই দেখা যায়। এবার ঘটেছে বাস্তবে। একটি-দুটি নয়, কেটে গেছে ৪০টি বছর। এর মধ্যে তাঁদের চেহারা, পথঘাট—পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। কিন্তু কমেনি রক্তের টান, প্রাণের আকুতি। এই টান আর আকুতির জন্যই দীর্ঘ ৪০ বছর পর দুই বোন ফিরে পেয়েছেন নিজেদের পরিচয়।
ওই দুজন হলেন ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মল্লিকা (আনোয়ারা) ও সাজেদা। স্বজনের খোঁজ পেয়ে গত সোমবার দুই বোনের মধ্যে বড়জন মল্লিকা সুদূর নেদারল্যান্ডস থেকে স্বামী ও দুই দত্তক মেয়েকে নিয়ে উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের খারুয়া মুকুন্দ গ্রামে মা-বাবার ভিটায় আসেন। স্বজনদের কাছে পেয়ে তাঁরা সুখের, আনন্দের কান্নায় ভেঙে পড়েন। তবে মা-বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি মল্লিকার। তাঁরা যে আর বেঁচে নেই।
সোমবার মল্লিকারা খারুয়া মুকুন্দ গ্রামে এলে চারদিকে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে। শত শত মানুষ এসে ভিড় করে তাঁদের দেখতে।
দুই শিশুকে নিয়ে চলে গেল ট্রেন
১৯৭৮ সাল। খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের মৃত ইন্তাজ আলীর স্ত্রী সমতা বেগম দুই শিশু সন্তান মল্লিকা (৫) ও সাজেদাকে (৪) নিয়ে পাশের ত্রিশাল উপজেলার বালিপাড়া গ্রামে বাবার বাড়িতে যান। ফেরার পথে গফরগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে সমতা ট্রেন থেকে নামতে পারলেও দুই মেয়ে নামতে পারেনি। এর মধ্যে ট্রেন ছেড়ে যায়। স্থানীয় অন্য সূত্রে জানা যায়, সমতা বেগম অভাবের তাড়নায় তাঁর দুই মেয়েকে গফরগাঁও রেলস্টেশনে ঢাকাগামী একটি ট্রেনে তুলে দিয়ে বিস্কুট ও চকোলেট আনার কথা বলে চলে যান। পরে ট্রেনটি ছেড়ে গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। তখন শিশু দুটি খুব কাঁদছিল। কান্না দেখে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসে শিশু দুটির মা-বাবা-অভিভাবকের খোঁজ করেন। তাঁদের না পেয়ে তিনি শিশু দুটিকে ট্রেন থেকে নামিয়ে টঙ্গীর দত্তপাড়ায় একটি মাতৃসদনে ভর্তি করে দেন।
মল্লিকা-সাজেদা গেল নেদারল্যান্ডস
১৯৮০ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসের এভার্ট বেকার ও মেরিয়ান্ট রেজল্যান্ড দম্পতি বাংলাদেশে এসে টঙ্গীর ওই মাতৃসদন থেকে শিশু মল্লিকাকে দত্তক নেন। পরে তাঁদের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের আরেকটি পরিবার দত্তক নেয় সাজেদাকে। সেখানেই বড় হয় মল্লিকা ও সাজেদা। দত্তক নেওয়া পরিবারের কাছে তাঁরা জানতে পারেন, তাঁদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। তবে জানতে পারেননি আত্মপরিচয়।
বড় হয়ে এলেন বাংলাদেশে
দুই বোন বড় হয়ে নিজেদের পরিচয়ের খোঁজে একাধিকবার বাংলাদেশ আসেন। মা-বাবা-স্বজনদের খুঁজে বেড়ান। কিন্তু কোটি কোটি মানুষের মধ্যে কোথায় পাবেন তাঁদের! এ নিয়ে পত্রিকায় ও বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর সূত্র ধরে অনেকেই তাঁদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ইত্যাদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গফরগাঁও থেকেও যোগাযোগ করেন কেউ কেউ। পরে তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মল্লিকা-সাজেদার ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় জানা যায়, গফরগাঁওয়ের খোঁজ করা লোকজনই মল্লিকা ও সাজেদার স্বজন।
অঝোরে কাঁদলেন তাঁরা
সোমবার বিকেলে ইত্যাদির একটি টিমের সঙ্গে মল্লিকা তাঁর স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের মা-বাবার ভিটায় আসেন। দেখা হয় ভাই-বোন-স্বজনদের সঙ্গে। বড় বোন ছলেমন নেছা ও ভাই ছুতু মিয়া হারিয়ে যাওয়া বোনকে পেয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। কাঁদেন মল্লিকাও।
ছুতু মিয়া বলেন, ‘অত বছর পরে বইনেরে (বোন) ফিইরা পাইছি; খুব ভালা লাগতাছে। কিন্তু খারাপ লাগতাছে বাবা-মার লাইগ্যা। তারা যুদি বাইচ্চা থাকতো!’
মল্লিকা বাংলা বলতে পারেন না। তিনি কথা বলেছেন দোভাষীর মাধ্যমে। মল্লিকা বলেন, ‘আমি এত দিন পর ভাই-বোন-স্বজনদের পেয়ে খুব খুশি হয়েছি।’
পরে তাঁরা মা-বাবার কবর জিয়ারত করেন। এ সময়ও আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
রাওনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাবুল আলম বলেন, ‘বিষয়টি খুবই আবেগের। ফিল্মে দেখা যায় হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে বহু বছর পর ফিরে পেতে। কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটবে, এটা ভাবতেও পারিনি।’
সূত্র জানায়, সাজেদা ছুটি পাননি। ছুটি পেলে তিনিও মাতৃভূমিতে আসবেন।