বৃহস্পতিবার, ২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ইং ১২ই আশ্বিন, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জটিল সমীকরণ

নিউজ ডেস্ক: মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর কথা। কিন্তু গত বছর ২৩ নভেম্বর হওয়া চুক্তির প্রায় ৮ মাস হতে চললেও এখনো তা শুরু হয়নি। প্রথম থেকে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মিয়ানমারের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সাড়া না পাওয়ায় এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাচ্ছে। তবে চীন রোহিঙ্গা ইস্যুকে আন্তর্জাতিকীকরণ না করে দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের কথা বলে আসছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত শুরুরও তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। অন্যদিকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো নিরাপদ পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। বাংলাদেশও চায় একটি নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক লোকের দীর্ঘদিন আশ্রয় দেওয়াটা দেশের জন্য কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এ অবস্থায় সব মিলিয়ে জটিল সমীকরণে পড়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া।

জাতিসংঘ মনে করে, মিয়ানমারে এখনো প্রত্যাবাসনের মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। এ মাসের শুরুতে বাংলাদেশ সফরে আসা জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা, যাতে রোহিঙ্গারা নিরাপদে ও মর্যাদাপূর্ণভাবে স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকার সমালোচনা করেছে। তাদের ভূমিকা সন্তোষজনক নয় বলেও মন্তব্য করেছে। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য মিয়ানমারের রাখাইনে এখনো নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে মনে করে সংস্থাটি।

গত ৮ জুলাই বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যা হয়েছে, তা স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন। এটি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কেননা বিশ্বের অন্য সাধারণ মানুষের মতো রোহিঙ্গাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তিনি বলেন, রাখাইনে এখনো পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। সে কারণে শিগগির রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি এখনো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত নয় বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) প্রেসিডেন্ট পিটার মাউরা। আইসিআরসি প্রেসিডেন্ট বলেন, রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সেখানে ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। প্রথম থেকে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মনোযোগী ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সাড়া না পাওয়ায় আলোচনায় অগ্রগতি যৎসামান্যই। বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

এদিকে চীন রোহিঙ্গা ইস্যুকে আন্তর্জাতিকীকরণ না করে দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের কথা বলে আসছে। প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ যে ৮ হাজার ৩২ জনের তালিকা পাঠিয়েছে তার মধ্য থেকে মিয়ানমার ৫৩৯ জনের বিষয়ে অনাপত্তি দিয়েছে। চীন তাদের দ্রুত রাখাইনে প্রত্যাবাসনের তাগিদ দিচ্ছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় কোনো জটিলতা দেখা দিলে তা নিরসনে মধ্যস্থতার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও দিয়েছে দেশটি। তবে চীনের প্রস্তাবের বিষয়ে এখনো বাংলাদেশ কিছু জানায়নি।
প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্ট সরকারি এক কর্মকর্তা বলেন, চীন যেভাবে চায়, সেভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রায় অসম্ভব। কারণ প্রত্যাবাসনের আন্তর্জাতিক নিয়ম হচ্ছে- এটি স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই হতে হবে। চীন যেমন চায় আমরাও চাই প্রত্যাবাসন দ্রুত শুরু করতে। কিন্তু সংকট হচ্ছে- রাখাইনে এখনো রোহিঙ্গাদের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ তৈরির কোনো তথ্য মিয়ানমার শেয়ার করেনি। মিয়ানমার প্রায়ই বলে- তারা যাচাইকৃতদের গ্রহণে প্রস্তুত। আসলে এটি তাদের স্টান্টবাজি।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ চায়- প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের যদি সদিচ্ছা থাকে, তা হলে তারা চুক্তির শর্তমতে বাস্তুচ্যুতদের জন্য নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং বসবাসের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করুক। চুক্তিতে এ নিয়ে মিয়ানমারের স্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে সম্মত হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের ফেরত যাওয়া নিয়ে সংশয় আছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি চাপে রয়েছে দেশটি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ফেরত এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা বন্ধে জোর দাবি জানাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা বলছে বলে মনে করেন তারা। মূলত আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনে মিয়ানমার এ কৌশল অবলম্বন করেছে।

এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে মিয়ানমারের ইউনিয়নমন্ত্রী কিয়াও টিন্ট সোয়েও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে ২৯ জুন। সেখানে মিয়ানমারের সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করতে রাজি হয় বাংলাদেশ। বৈঠকে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ আছে কিনা, সেটিও জানতে চাওয়া হয়। ওই বৈঠকেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখাইনে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে মিয়ানমার রাজি হয়।

এদিকে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক গত মঙ্গলবার বলেন, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার মতো সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে কিনা, তা দেখার জন্য শিগগিরই মিয়ানমারে যাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে কিনা, ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে কিনা, তাদের চলাফেরা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কী অবস্থা হবে, সেটি দেখতে তিনি মিয়ানমারে যাবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কবে যাচ্ছেন, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সচিব নির্দিষ্ট কোনো তারিখ বলতে পারেননি। অবশ্য তিনি বলেন, শিগগিরই যাবেন। সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়ে গেলে প্রত্যাবাসন দ্রুত শুরু হবে বলে আশা করি। বেশ কিছু নাম যাচাই-বাছাই হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, শিগগিরই প্রত্যাবাসন শুরু হবে। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি জটিল। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে এটি যত দ্রুত এগিয়েছে, অন্য দেশে তত দ্রুত সম্পন্ন হয়নি।