ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নযাত্রা শুরু যেভাবে
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। স্বাধীন হওয়ার মাত্র ৭ বছরের মধ্যে সেমিফাইনালে। আবার হারিয়ে যাওয়া। মদরিচ, রাকিতিচ, পেরিসিচদের হাত ধরে এবার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়া। স্বপ্ন—বিশ্বকাপটা প্রথমবারের মতো দেশে আনা রেফারি চুনিয়েট চাচিরের শেষ বাঁশি বাজতেই ক্রোয়েশিয়ান প্রতিটি মানুষ যেন নিজ নিজ জায়গা থেকে একটা চিৎকার দিয়ে উঠল। এ সেই বাঁশি, যে বাঁশিতে এর আগেও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে এসে। ৪৫ লাখ মানুষ ১৯৯৮ বিশ্বকাপটা দেখেছে অপার আনন্দ নিয়ে। স্বাধীন দেশের হয়ে প্রথম বিশ্বকাপ খেলার আনন্দ। এই আনন্দের পেছনেই লুকিয়ে আছে অক্লান্ত কষ্ট, নিরন্তর পরিশ্রমের গল্প।
ক্রোয়েশিয়া, যুগোস্লাভিয়ার বাইরে বেরিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রথম ম্যাচ খেলে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ১৯৯০ সালে। ফিফা এই ম্যাচকে অনুমোদন দেয়নি, তবু এটিই তাদের ইতিহাসের প্রথম ম্যাচ। কাগজে-কলমে সার্ব নিয়ন্ত্রিত যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ক্রোয়েশিয়ায় স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালের ৩১ মার্চ। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার আসল স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালের ১৩ মার্চ।
দেশজুড়ে তখন যুগোস্লাভিয়া ভেঙে বিভিন্ন দেশ গড়ার আন্দোলন। সেই আন্দোলনে সফলতার জন্য সবাই বেছে নিল ভালোবাসার ফুটবলকে। ক্রোয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় ফুটবল দল ডায়নামো জাগরেব, আর অখণ্ড যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডের ক্লাব রেড স্টার বেলগ্রেড। দুই দলের উগ্রপন্থী সমর্থকেরা ম্যাচটাকেই লক্ষ্য বানায়। ১৩ মে ১৯৯০ সালে যুগোস্লাভিয়ার লিগ ম্যাচে মুখোমুখি হয় ডায়নামো জাগরেব ও রেড স্টার বেলগ্রেড।
ম্যাচের মাঝে যেন রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা। দুই দলের সমর্থকদের লড়াই নেমে এল মাঠে। পুলিশও নেমে পড়ল দাঙ্গা থামাতে। দাঙ্গা থামাতে গিয়ে গ্রেপ্তার করল ডায়নামো জাগরেবের এক সমর্থককে। সেটা দেখে ফেলেন সে সময়ের যুগোস্লাভিয়ার সেরা খেলোয়াড় জবেনমির বোবান। লাথি বসিয়ে দেন পুলিশের মুখে। সেই সুযোগে সমর্থক পালিয়ে যান। ওই সময় থেকে সেই লাথি হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীনতার প্রথম সোপান, ‘বোবানের লাথি’। এ যুদ্ধ প্রভাব ফেলেছে সেই সময়ের খেলোয়াড়দের ওপর, বাদ যায়নি পরবর্তী প্রজন্মও।
লুকা মদরিচের শৈশব কেটেছে লুকিয়ে লুকিয়ে। সঙ্গী তাঁর শুধু একটি বল, যে বলের আঘাতে স্মৃতির দাগ কেটে গেছে কত কত হোটেলের কাচে! ইভান রাকিতিচ যখন কোলের শিশু, তাঁকে কোলে করেই সুইজারল্যান্ড পালাতে হয়েছে তাঁর বাবা-মাকে। দেয়ান লভরেনকে বেড়ে উঠতে হয়েছে এই যুদ্ধের মাঝেই।
যুদ্ধের পর নতুন দেশের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজেদের দুর্দশা যেমন দেখল ক্রোয়েশিয়া, তেমনি দেখল সম্ভাবনাও। ১৯৯০ বিশ্বকাপে যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধিত্ব করা পাঁচজন খেলোয়াড় দেশের টানে চলে আসে ক্রোয়েশিয়ায়। সেই সঙ্গে বোবান, ডেভর সুকারদের নিয়ে ফুটবলকেই সেরা শক্তি হিসেবে পেল ক্রোয়াটরা। বোবান, সুকার, প্রোসিনেস্কিদের নিয়ে গড়া দল ১৯৯৬ সালের ইউরোতে পেরিয়ে গেল প্রথম পর্ব! কিন্তু জার্মানদের কাছে হেরে ইউরো-স্বপ্ন ধূলিসাৎ।
১৯৯৮ বিশ্বকাপে বোবান, সুকার, বিলিচদের ঘিরে প্রথম সোনালি যুগ এসেছিল ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলে। গ্রুপ পর্ব কাটিয়ে তরতর করে এগিয়ে গেল অভিষিক্ত দেশটি। রোমানিয়াকে হারিয়ে জার্মানির ওপর প্রতিশোধ নিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় ক্রোয়াটরা। ফ্রান্সের কাছে হেরে গেলেও তৃতীয় হয়েই বিশ্বকাপ শেষ করেছে ক্রোয়েশিয়া। সেই যেন শেষ, এরপর আর কোনোভাবেই ফুটবলে নিজেদের পাচ্ছিল না তারা।
হঠাৎ করেই যেন তারকাশূন্য হয়ে গেল ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু অলিগলিতে ভালো খেলোয়াড়ের অভাব নেই। সেই খেলোয়াড়দের জন্য দরকার ভালো জায়গা। যেখানে বড় হতে পারবে নতুন প্রজন্ম। দায়িত্বটা নিল দেশের ক্লাবগুলো। মদরিচ, রাকিতিচ, মারিও মানজুকিচের মতো খেলোয়াড়দের অলিগলি থেকে তুলে আনল তারা। যাঁরা কিনা ভবিষ্যতে এই দেশের হাল ধরতে পারবেন। বর্তমানে বিশ্বকাপের ত্রিশোর্ধ্ব তারকাদের বড় একটা অংশ সে চেষ্টারই ফসল।
ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো ক্রোয়েশিয়ায়ও ভালো ভালো খেলোয়াড় তৈরি হয় রাস্তায়। তাদের অপেক্ষা শুধু খুঁজে এনে এদের কাজে লাগানো। ডায়নামো জাগরেব, হাদুক স্প্লিট, রিজেকার মতো দল খেলোয়াড় তৈরিতে ওস্তাদ। বোবান, সুকারদের দেখানো পথে মদরিচ, রাকিতিচরা উঠে এসেছেন বিশ্বকাপের ফাইনালে। তাঁদের স্বপ্ন এখন ব্যাজের ওপর একটা তারা বসানো, সে তারাকে লক্ষ্য করেই উঠে আসবে নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়েরা।