প্রিয় বন্ধুকে টুকরো করে সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলে দেয় পিন্টু
‘পুরো পৃথিবী এক দিকে, আর আমি অন্য দিক/ সবাই বলে করছ ভুল, আর তোরা বলিস ঠিক/ তোরা ছিলি, তোরা আছিস/ জানি তোরাই থাকবি/ বন্ধু বোঝে আমাকে, বন্ধু আছে আর কী লাগে?’ শিল্পী তপুর গাওয়া এ গানটা মনে পড়ে? বন্ধুত্ব ঠিক যেন এমনই। মানুষও যুগ যুগ ধরে এই বন্ধুত্বকে উদ্যাপন করেছে। কিন্তু এমনও কি বন্ধু আছে যে কি না অর্থ, সেবা এবং প্রাণ বাঁচানোর বদলে বন্ধুকে হত্যা করতে ভাড়া করে ‘কন্ট্রাক্ট কিলার’? এমনকি সেই প্রিয় বন্ধুকেই হত্যা করে তার লাশ টুকরো টুকরো করে সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলে দিতেও কি বুক কাঁপেনি তার!
এমনই এক বন্ধুর মুখোশে লুকিয়ে থাকা ঘাতকের নাম পিন্টু দেবনাথ। নারায়ণগঞ্জে খুন হওয়া স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর চন্দ্র ঘোষের প্রিয় বন্ধু সে। কিন্তু কী কারণে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড? সে ব্যাপারে একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছে সে! উদ্ধার হওয়া নিহত প্রবীর দেবনাথের লাশের বাকি অংশের সন্ধান করছে পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জ শহরের কালীরবাজারের স্বর্ণ মার্কেট থেকে নিখোঁজের ২১ দিন পর গত সোমবার রাতে প্রবীরের টুকরো টুকরো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মঙ্গলবার গ্রেফতার পিন্টু দেবনাথ ও তার কর্মচারী বাপন ভৌমিক ওরফে বাবুকে আদালতে হাজির করলে আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
এদিকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীরের লাশের সন্ধান পাওয়ার পর শোকে স্তব্ধ নগরীর কালীরবাজারের স্বর্ণপট্টি। এ হত্যার প্রতিবাদে কালীরবাজারের ব্যবসায়ী সমিতি দোকানে দোকানে কালো পতাকা টানিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে।
জানা গেছে, নিহত প্রবীর ঘোষের মালিকানা ভোলানাথ জুয়েলার্সের পাশেই পিন্টু জুয়েলার্স। এই পিন্টু জুয়েলার্সের মালিক পিন্টু দেবনাথের সঙ্গে প্রবীর ঘোষের বন্ধুত্ব অনেক পুরনো। ক’বছর আগে পিন্টু দেবনাথ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। সংকটাপন্ন অবস্থায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন বন্ধু প্রবীর ঘোষ। উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান ভারতের মাদ্রাজে।
ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয় সেখানে। পরিচর্যার দায়িত্ব উঠিয়ে নেন নিজ কাঁধে। এর জন্য যত ব্যয় সবকিছুই করেন বন্ধু প্রবীর ঘোষ। সেই পিন্টু দেবনাথের বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকেই প্রবীর ঘোষের লাশ উদ্ধারের দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবাই হতবাক। প্রবীর ঘোষ নিখোঁজ হওয়ার পর তার সন্ধানের দাবিতে আন্দোলনেরও অন্যতম ছিলেন পিন্টু।
জানা গেছে, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এ হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত স্বীকার করেছে পিন্টু ঘোষ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে পিন্টু জানিয়েছে, প্রবীরকে হত্যা করার পূর্বপরিকল্পনা ছিল তার। এজন্য সে বেছে নেয় ঈদের সময়টি। ওই সময় পুরো কালীরবাজার স্বর্ণ মার্কেটটি বন্ধ থাকে।
প্রবীরকে ডেকে এনে তাকে সুকৌশলে পিন্টুর বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়, কালীরবাজারের পাশে আমলাপাড়া এলাকা দিয়ে যেখানে কোনো সিসিটিভি ছিল না। বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে আগে থেকে ভাড়া করা কয়েক কন্ট্রাক্ট কিলার মিলে প্রবীরকে হত্যা করে ওই ফ্ল্যাটেই লাশ টুকরো করা হয়।
লাশের অংশগুলো সিমেন্টের ব্যাগে ভরে ফেলে দেয়া হয় বাড়ির নিচ তলার সেপটিক ট্যাঙ্কে। তবে লাশের পায়ের নিচের অংশটি ট্যাঙ্কে পাওয়া যায়নি। পিন্টু জানিয়েছে, তার ঘরের কাঁথা ও বালিশ দিয়ে সব রক্তের দাগ মোছা হয়েছে। হত্যার পর প্রবীরের মোবাইল ফোনটি দেয়া হয় পিন্টুর সাবেক কর্মচারী বাপনকে।
বাপন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম শিবের বাজার এলাকা থেকে প্রবীরের মোবাইল ফোনের সিম তার ব্যবহৃত মোবাইলে প্রবেশ করিয়ে ১ কোটি টাকা মুক্তিপণের এসএমএস দেয়। মূলত এই এসএমএসের সূত্র ধরেই গ্রেফতার করা হয় দুইজনকে। তবে হত্যার মূল কারণ এখনও জানায়নি পিন্টু।
এদিকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষ মূলত আর্থিক লেনদনের বিরোধের কারণেই খুন হয়ে থাকতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রবীর ঘোষের এক ভাই সৌমিক ঘোষ ইতালিপ্রবাসী। সেখান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠানো হয় প্রবীর ঘোষের কাছে।
দীর্ঘদিন ওই টাকা লেনদেন হতো প্রবীর ও পিন্টুর মধ্যে। সম্প্রতি সৌমিক ঘোষ যখন দেশে আসে, তখন থেকেই নিখোঁজ ছিল প্রবীর। সৌমিক দেশে আসার আগেই টাকার জন্য পিন্টুকে চাপ দিতে থাকে প্রবীর। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। পরে পরিকল্পনা করেই প্রবীরকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে পিন্টু ও তার দোকানের কর্মচারী বাপেন ভৌমিক।