১৪ই নভেম্বর, ২০১৬ ইং, সোমবার ৩০শে কার্তিক, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ


মার্কিন সমাজে বিভক্তি স্পষ্ট করেছে নির্বাচন


Amaderbrahmanbaria.com : - ১০.১১.২০১৬

 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতেই যুক্তরাষ্টজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাচনের আগে থেকেই অভিবাসী আমেরিকান, মুসলিম সম্প্রদায়, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আর কৃষ্ণাঙ্গদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিলেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই মানুষেরা তীব্র হতাশা প্রকাশ করেছেন ট্রাম্পের বিজয়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এরা বিক্ষোভে নেমেছেন, যা সাম্প্রতিক নির্বাচনি ইতিহাসে দেখা যায়নি।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই বিজয়কে মার্কিন সমাজে থাকা বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের মানুষে মানুষে বিভক্তিকেই স্পষ্ট করেছে। সাম্প্রতিক কিছু জরিপেও মিলেছে একই আভাস। এদিকে নির্বাচনের মাত্র ক’দিন আগে সাড়া জাগানো মার্কিন তথ্যচিত্র নির্মাতা মাইকেল মুরও ট্রাম্পকে বিভক্তির প্রতীক বলে উল্লেখ করেছিলেন। একইভাবে এথিকস অ্যান্ড পাবলিক পলিসি সেন্টারের কর্মকর্তা হেনরি অলসেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মেটাল কোম্পানির প্রেসিডেন্ট স্টিফেন গ্লিসনও সমাজের অভ্যন্তরে বিরাজিত বিভক্তিকে ট্রাম্পের উত্থানের কারণ মনে করছেন। ব্লুমবার্গ পলিটিক্সের এক বিশ্লেষণও বলছে একই কথা। তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে ট্রাম্পের জয় ওই বিভক্তিকেই নির্দেশ করে।
নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার আভাস পেতেই যুক্তরাষ্ট্রে স্পষ্ট হতে থাকে হতাশা। গার্ডিয়ানে নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে নিজেদের অনুভূতি তুলে ধরেছেন এমনই কয়েকজন হতাশ মার্কিনি। জর্জিয়া, ওয়াশিংটন ও পেনসিলভ্যানিয়া অঙ্গরাজ্য তাদের আবাস। এদের একজন হলেন জর্জিয়ার বাসিন্দা নারেন। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, মানুষ অনেক ক্ষুব্ধ। পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটিই ছিল অন্যরকম। পোল ছিল প্রতারণামূলক। বিশ্বঐতিহ্য বদলে যাচ্ছে, পোলের ফলাফল আর যথাযথ হচ্ছে না। এই দেশের স্বতন্ত্র যে বৈশিষ্ট্য আমাদের স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, সেটাই আর নেই। জানি না ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কী জবাব দেবো।’ নিজের দেশটাকে জচনতে পারছেন না উল্লেখ করে ওয়াশিংটনের বাসিন্দা র‌্যাচেল-এর প্রশ্ন, ‘ট্রাম্পের ঘৃণা, পুরুষতান্ত্রিকতা আর বর্ণবাদপূর্ণ বার্তা কী করে এত মানুষকে অনুপ্রাণিত করে?’ পেনসিলভ্যানিয়ার বাসিন্দা মারিয়ার প্রশ্ন, ‘ আমরা আর কতদিন লড়াই করবো? আমাদের সন্তানরা, তাদের সন্তানরা? একটা জিনিসই কেবল দেখতে পাচ্ছি, আমরা আর সেই দেশ নই যে দেশ সামাজিক বর্ণবাদ, লৈঙ্গিক বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিকতাকে অস্বীকার করে।’
ট্রাম্পের বিজয়ের আভাস পাওয়ার পর থেকেই দানা বাধতে শুরু করে বিক্ষোভ। তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু অভিবাসী, সম্প্রদায়, তৃতীয় লিঙ্গের কিংবা কৃষ্ণাঙ্গরাই এবার বিক্ষোভে নেমেছে অকল্যান্ড থেকে ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা কিংবা অরিগন থেকে ওয়েস্ট কোস্ট, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ওয়েস্ট কোস্টে। ‘ফ্যাস্টিস্ট’, ‘বর্ণবাদী’ ও ‘পুরুষতান্ত্রিক’ ট্রাম্পের আমেরিকায় কীভাবে টিকবেন, তাই নিয়ে চিন্তিত ও হতাশ তারা। এই হতাশাই বিক্ষোভে রূপান্তরিত হয়েছে। মঙ্গলবার রাতেই ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই এ বিক্ষোভ শুরু হয়। বুধবার সকাল থেকে সে বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউসের সামনেও বিক্ষোভ করেন একদল ট্রাম্পবিরোধী।
গত সেপ্টেম্বরে নমুনায়নের দৈবচয়ন পদ্ধতি ব্যবহার করে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ২,০১০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে এক জরিপ পরিচালনা করে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাবলিক রিলিজিয়ন রিসার্স ইন্সটিটিউট (পিআরআরআই)। পিআরআরআই-এর নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র যে পথে যাচ্ছে তা নিয়ে মানুষের আশাবাদ ২০১২ সালের নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ভয়াবহভাবে নেমে গেছে। এখন ৭৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র ঠিক পথে যাচ্ছে, অথচ ২০১২ সালের নির্বাচনের সময় ৫৭ শতাংশ মানুষ এমন ভাবত।
আরআরআই-এর প্রধান নির্বাহী রবার্ট জোন্স বলেছিলেন, ‘মার্কিনিদের ভবিষ্যত প্রশ্নে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের জন্য একটি গণভোটের রূপ ধারণ করেছে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক ১৯৫০ এর দশকের সময়গুলো নিয়ে স্মৃতিকাতর হন। ওইসময় দেশে শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টানদের অনেক বেশি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতা ছিল। অন্যদিকে হিলারি ক্লিনটনের সমর্থকরা গত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে যে বড় ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হয়েছে তাতে খুশি।’
তবে নির্বাচনে মার্কিনিরা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে ট্রাম্পের নিরঙ্কুশ বিজয় সেই সম্মিলনের সংস্কৃতিকে জয়ী করেনি। বিপরীতে তারা বিভিক্তিকেই বেছে নিয়েছে। ট্রাম্পের মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন শ্লোগানই বুকে ধারণ করেছেন তারা। ফিরে যেতে চেয়েছেন সেই ৫০ এর দশকে।
নির্বাচনের পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও একইভাবে ওই বিভক্তিকে সামনে এনেছে। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস বলছে, এটি বিভক্ত আমেরিকায় ট্রাম্পের জয়। ব্লুমবার্গ পলিটিক্স এর ভাষ্য, বিভক্ত জাতির প্রেসিডেন্ট হলেন ট্রাম্প। টেলিগ্রাফ বলছে শেষ পর্যন্ত বিভক্ত আমেরিকারই বিজয় হলো! দ্য কনজারভেশন লিখেছে মার্কিন সমাজে বিভক্তির বিষ ছিটিয়ে কুৎসিত জয় পেয়েছেন ট্রাম্প।
ক’দিন আগে সাড়া জাগানো মার্কিন তথ্যচ্চিত্র পরিচালক মাইকেল মুর বলেছিলেন, মুর মনে করেন ট্রাম্পপন্থী ভোটাররা মিশিগান, ওহাইয়ো, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনকে ‘ব্রেক্সিট রাজ্যে’ পরিণত করবেন। মুর বলেন, ‘ব্রেক্সিট একটি বড় অংশে পাশ করেছে তার কারণ হচ্ছে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের শিল্প খাতের কর্মজীবী শ্রেণি ইউরোপ থেকে বের হতে চেয়েছে। কিন্তু জিনিসটা হয়ে যাওয়ার পর তারা উপলব্ধি করেছেন, ‘এখন তো আমাদের ইউরোপ থেকে বের হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার আমরা ইউরোপ থেকে বের হওয়ার জন্য ভোট দিচ্ছি না, কিন্তু ট্রাম্পকে ভোট দিলে আমেরিকাকেই আমেরিকা থেকে বের করে দেওয়া হবে। ’
এথিকস অ্যান্ড পাবলিক পলিসি সেন্টারের কর্মকর্তা হেনরি অলসেন মনে করেন, ‘এটা নির্ভর করে আপনি সমাজের স্বর কতোটা শুনতে পারছেন তার ওপর। মানুষ যখন সমাজের স্বাভাবিকতার সাপেক্ষে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে, তখন তারা সমাজে নিজেদের সংযুক্তির প্রশ্নে মরিয়া হয়ে চরমপন্থাকেই নিজেদের অস্ত্র করে তোলে।’ তিনি মনে করেন, সমাজেই চরমপন্থার বাস্তবতা হাজির রয়েছে।’

এথিকস অ্যান্ড পাবলিক পলিসি সেন্টারের কর্মকর্তা হেনরি অলসেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মেটাল কোম্পানির প্রেসিডেন্ট স্টিফেন গ্লিসন। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্নাতককে সিএনএন, ফক্স নিউজ, সিএনবিসি, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ওয়াশিংটন টাইমস এবং ন্যাশনাল রিভিউয়ের মতো সংবাদমাধ্যমগুলো তাকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা তিনি মনে করেন, ২০১৬ সালের নির্বাচন মার্কিন সমাজের কদর্যতাগুলোকে সামনে এনেছে। ভাঙচুর থেকে শারীরিক আঘাত থেকে বড় মাত্রার বর্ণবাদী দাঙ্গা থেকে জঙ্গিবাদী বোমা হামলা এবং বিপণী কেন্দ্রে ছুরিকাঘাত, দুই দলে বিভক্ত আমেরিকায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা জনজীবনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি মনে করেন, গোটা সমস্যায় ট্রাম্পকে দায়ী করার একটা প্রবণতা রয়েছে, সেখানকার প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাশক্তির। তবে এর সঙ্গে দ্বিমত করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে ট্রাম্পের সমর্থকরা রাজনৈতিক সহিংসতার ধারক নয় বরং শিকার। উপরন্তু সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করার মতো শক্তিগুলো বছরের পর বছর ধরে তৈরি হয়ে আসছিলো। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট, কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ মিলে বিপুল সংখ্যক আমেরিকান একমত যে ওবামার অধীনে আন্তঃবর্ণ সম্পর্ক তিক্ততর হয়েছে। দেশের প্রথম আধা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারংবার বর্ণবাদি উস্কানিদাতাদের পক্ষ নিয়েছেন এবং পুলিশবিরোধী দাঙ্গার সমালোচনা করেছেন। তার অ্যাটর্নি জেনারেল, লরেটা লিঞ্চ বিদ্বেষপূর্ণ বর্ণবাদী বয়ানের আইনি বৈধতা দিয়েছেন যার বাস্তব ভিত্তি নেই বললেই চলে।’
স্টিফেন গ্লিসন মনে করেন, ওবামার বর্ণবাদী শাসনপ্রণালীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন বর্ণবাদী ক্ষত নিয়ে দেশত্যাগ, জাতীয় ঋণ প্রায় প্রায় দ্বিগুণ হওয়া (২০ ট্রিলিয়ন), ঐতিহাসিকভাবে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া, খাদ্য সংকটের তীব্রতা এবং খোদ মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বাস্থ্যবীমার মতো জরুরি বিষয়গুলোর সামর্থ্য না থাকার প্রশ্নগুলো ২০১৬ সালে নির্বাচনি পরিস্থিতিকে এমন হতাশাব্যঞ্জক-অস্থির-সহিংস করে তুলেছে।





Loading...


প্রকাশকঃ মোঃ আশ্রাফুর রহমান রাসেল
সম্পাদক : বিশ্বজিত পাল বাবু
চেয়ারম্যান : আলহাজ্ব নুরুজ্জামান
ঠিকানা : ৬০৩ ফুলবাড়িয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
email : [email protected] (news)
Phone: +880851 62307
+8801963094563


close