তামান্না উকিল বাংলাদেশি
তাঁর শৈশব কেটেছিল কুমিল্লার মুরাদনগরে। মা-বাবা দুজনই শিক্ষকতা করতেন। বাবা নিজের নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন অধ্যাপক আব্দুল মজিদ কলেজ। হোমনার রেহানা মজিদ কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা রোমিনের মা। তিন বোনের মধ্যে রোমিন দ্বিতীয়।
প্রথম শ্রেণিতে প্রথম
মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন রোমিন। এসএসসিতে ঢাকা বোর্ডে মানবিক বিভাগ থেকে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় এবং এইচএসসিতে প্রথম হয়েছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। ২০০৭ সালে স্নাতক হন। স্নাতকোত্তর হন ২০০৯ সালে। উভয় পরীক্ষায়ই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। অসাধারণ ফলাফলের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনটি স্বর্ণপদক পেয়েছেন।
আমেরিকায় গেলেন
স্নাতকোত্তর শেষ করার পরপরই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন আইনের শিক্ষক হিসেবে। বছর না ঘুরতেই ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ এবং ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো—দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই সুযোগ তৈরি হয় এলএলএম (মাস্টার্স অব ল) করার। সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। শেষে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোকে বেছে নেন। ভর্তি হন স্কুল অব ল-তে। রোমিন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পাঁচটি ল স্কুলের মধ্যে শিকাগো ল স্কুল একটি। আমি যে বছর সেখানে পড়াশোনা শুরু করি, সেইবার ৩২টি দেশ থেকে এলএলএম শিক্ষার্থী ছিল ৬৭ জন। প্রথম কয়েক মাস নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে এবং সক্রেটিক (গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের নামানুসারে) মেথডে ক্লাস করতে বেগ পেতে হয়েছে। সক্রেটিক মেথডে লেকচারভিত্তিক ক্লাস হয় না। এটা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক অংশগ্রহণমূলক পাঠদানব্যবস্থা। এখানে শিক্ষক ছাত্রদের উদ্দেশে চিন্তা উদ্দিপক জটিল প্রশ্ন ছুড়ে দেন। প্রতিটি ক্লাসই পরীক্ষার মতো।’
এবার গবেষণায়
শিকাগোতে এলএলএম শেষ করার পরপরই আইনের ওপর উচ্চতর গবেষণার জন্য ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আরবানা-শ্যাম্পেইন থেকে স্কলারশিপ পান রোমিন। শুরু করেন জেএসডি প্রগ্রাম। অনেক দেশেই এটি পিএইচডি ইন ল নামে পরিচিত। বিখ্যাত পরিবেশ আইনবিদ অধ্যাপক এরিক টি ফ্রাইফোগল ছিলেন রোমিনের অ্যাডভাইজর। ডক্টরাল ডিসার্টেশনে (নিবন্ধ) তিনি এক নতুন রিসার্চ ফ্রেমওয়ার্ক বা গবেষণা কাঠামোর প্রস্তাব করেন। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদীর মতো প্রাকৃতিক সম্পদ আরো কার্যকরভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। তামান্না সেখানে বলেন, শুধু পানির হিস্যা বা ভাগাভাগি নয়; বরং আন্তর্জাতিক নদী-ব্যবস্থাপনা হতে হবে এমন, যেখানে নদীতীরবর্তী মানুষ ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সামাজিক ন্যায্যতাও সুরক্ষিত হবে।
বার পরীক্ষায়ও পাস
ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করার পরপরই টেক্সাস বার পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন রোমিন। ১৫ ঘণ্টার এই পরীক্ষা চলে তিন দিন ধরে। রোমিন এ পরীক্ষায়ও সাফল্যের সঙ্গে পাস করেন, যদিও সেইবার পাসের হার ছিল মাত্র ৪৫ শতাংশ। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আইনজীবী হিসেবে টেক্সাস বারে নাম লেখান গেল সেপ্টেম্বরে। শপথ নিয়েছেন অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন
রোমিন স্নাতকোত্তর হওয়ার পরের কয়েক বছর আইন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। শেষে ২০১৩ সালে আবেদন করার সুযোগ আসে। তত দিনে তিনি পিএইচডির কাজ শুরু করে দিয়েছেন। যা হোক, আবেদন করলেন। যোগও দিলেন আইন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে। ক্লাস নিয়েছিলেন ছয় মাসের মতো। এরপর আবার শিক্ষা ছুটি নিয়ে আমেরিকা চলে যান। উল্লেখ্য, এ বছরের শুরু পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন রোমিন। এ ছাড়া ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের একজন আইনজীবী হিসেবেও তালিকাভুক্ত আছেন।
কঠিন ছিল সেসব দিন
যুক্তরাষ্ট্রে এখন অনেক বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আইনজীবী আছেন, যাঁরা ওখানেই জেডি করে আইনজীবী হয়েছেন; কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আইন পড়ে এসে সেখানে জেডি না করেই প্র্যাকটিস করছেন বা বার লাইসেন্স অর্জন করেছেন, এমন কাউকে পাননি রোমিন। পাননি এমন কোনো বাংলাদেশিকে, যিনি সেখানে জেএসডি ডিগ্রি নিয়েছেন। সেদিক থেকে রোমিনই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি আমেরিকায় জেএসডি ডিগ্রি নিয়েছেন। তাই কিভাবে কী করবেন—শুরু থেকেই স্পষ্ট ধারণা ছিল না। একেবারে অচেনা পথে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিজের গন্তব্যে পৌঁছতে হয়েছে তাঁকে। এরই মধ্যে জেএসডি গবেষণার শেষ বছরেই জন্ম হয় রোমিনের মেয়ে নিরন্তির। মেয়েকে নিয়ে একই সঙ্গে পড়াশোনা এবং তারপর বার প্রস্তুতি নেওয়া সহজ ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রে যাঁরা আইন পড়তে চান, তাঁদের উদ্দেশে রোমিন বলেন, এখানে আইন পড়াশোনা কঠিন, ব্যয়বহুল ও উন্নতমানের। সাধারণত ল স্কুল থেকে কোনো রকম স্কলারশিপ দেওয়া হয় না। রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট বা টিউটর হিসেবে কাজ করারও কোনো সুযোগ নেই। তাই কেউ এখানে পড়তে এলে হয় সম্পূর্ণ নিজ খরচে অথবা কোনো ফান্ডিং সোর্স যেমন ফুলব্রাইট বা অন্য কোনো স্কলারশিপ নিয়ে আসতে হয়। জেএসডিতে স্কলারশিপের সুযোগ খুবই সীমিত।
স্বামী-সন্তানসহ রোমিন
ব্যক্তিগত জীবনে রোমিন
২০১০ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন রোমিন। স্বামী ড. হাসিব উদ্দিন বুয়েটে যন্ত্রপ্রকৌশলে পড়াশোনা করেছেন। পরে একই বিষয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি করেন ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়, আরবানা-শ্যাম্পেইন থেকে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে হ্যালিবার্টন এনার্জি সার্ভিসেস কম্পানিতে প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট)। তাঁদের একমাত্র কন্যা নিরন্তি মাহ্ভীন হাসিবের বয়স আড়াই বছর।