‘যে নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিল, সে নাম বিশ্বের মানুষের মুখে মুখে’
নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গে তার কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যে নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিল, সে নাম আজ বিশ্বের মানুষের মুখে মুখে। সত্যকে কখনো মুছে ফেলা যায় না, ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া যায় না। জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্বের অন্যতম ভাষণ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।’
আজ শুক্রবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ‘সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য ন্যাশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক বইটির প্রথম খণ্ডের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথির ভাষণে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই বইটিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষণ আন্দোলন সম্পর্কিত অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান মিলবে। যা সঠিক ইতিহাস জানতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে। কারণ, এটা জাতির পিতার বিপরীত চিন্তার মানুষের কাজ। অর্থাৎ পূর্বপাকিস্তান সরকারের ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ (ইবি) ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যেসব রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ করেছেন। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক শ্রমিক তথা মেহনতী মানুষের কল্যাণে তিনি কী কী করেছেন। মানুষের মুক্তির জন্য তিনি দেশব্যাপী কী কী কর্মসূচি করেছেন ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ লিপিবদ্ধ করে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই রিপোর্ট তো জাতির পিতার বিরুদ্ধে তবে কেন আমরা প্রকাশ করতে গেলাম। খুব স্বভাবতই এমন প্রশ্ন আসতে পারে। আমি এজন্যই করেছি যে, বিরুদ্ধ মতের মানুষেরা বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে নজরদারিতে রেখেছে, তাদের দৃষ্টিতে জাতির পিতা কোন কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। কী কী আন্দোলন করেছেন। এটা পড়ার পর কোনো মানুষের মনে সংশয় থাকবে না।’
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশে এমন নজির নেই যে বিরুদ্ধ পক্ষের তথ্য দিয়ে বই রচনা করে। আমি মনে করি এই বইটি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রচনায় আকড় গ্রন্থ হিসেবে কাজ করবে। এসময় বইটির বিভিন্ন অংশের উদ্ধৃতি তোলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সতীর্থ সাহিত্যিক বেবী মওদুদের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি আমার বন্ধু বেবী মওদুদ মিলে দীর্ঘদিন ধরেই এ কাজটি করছিলাম। ১৯৯৬ সালে প্রথম যখন ক্ষমতায় আসি তখন যখন এস বি-র ডি আইজি ছিলেন সামসুদ্দিন সাহেবকে বলেছিলাম এসবি সংগ্রহ শালায় এমন রত্মগর্ভার আছে তা যেন তিনি সংরক্ষণ করেন। পরবর্তীতের ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী তখন এসবির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তার ২২জন এসবির সদস্য নিয়ে নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে এ কাজটি করে যান। আমি দেখেছি এরা এ কাজটি করতে গিয়ে কীভাবে মগ্ন হয়ে যান। কত কষ্ট করে এই নথিগুলোকে উদ্ধার করে কাজটি সম্পাদন করেন। তাদের এ আন্তরিকতার জন্য তিনি খুশি হয়ে বইটির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার সঙ্গে ছবি তোলেন। এবং পরবর্তী ১৪ খণ্ড দ্রুততার সঙ্গে প্রকাশের জন্য বইটির প্রকাশক হাক্কানী পাবলিশার্সের কর্নধারকে বলেন।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী তার ছোট বোন শেখ রেহানা, বোনের ছেলে ববীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে পুলিশের আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘আমি যখন খবর পাই যে স্পেশাল ব্রাঞ্চের সংগ্রহ শালায় এমন নথি আছে তখন সেখানে যাই। দেখি কী অবস্থায় আছে এসব নথিগুলো। তখন আমার সহকর্মীরা বলেছিল, স্যার এটা বোধহয় করা সম্ভব হবে না। কারণ ময়লা ধুলাবালি আর কাগজের স্তুপ। সেখানে কাজ করতে গিয়ে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। কিন্তু আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লোবস পরে কাজে হাতে দেই। এক পর্যায়ে গিয়ে একটা বান্ডেল পাই।’
আইজিপি বলেন, ‘কী পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যে নথিগুলোকে উদ্ধার করি তা বলে বোঝানো যাবে না। কাগজে হাত দেওয়ার পর বিস্কুটের মতো ভেঙে যেতো। আর্কাইভের স্পেশালিস্টদের যুক্ত করি এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে কাজটি করি।’
সভাপতির বক্তব্যে ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জীবনে অনেক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছি কিন্তু আজকের মতো এমন দুর্লব বইয়ের মোড়ক উন্মোচন এই প্রধম করলাম। এত পরিশ্রম করে এমন অপূর্ব বই পৃথিবীর আর কোথাও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমি মনে করি এই বইটি না হলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রচনা সম্ভব হতো না।’
অনুষ্ঠানের আলোচক বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘এই বইটি পাঠ করার পর শুধু বঙ্গবন্ধুর নয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস স্পষ্ট হবে। বঙ্গবন্ধুর উপর একটি পূর্ণ জীবনী গ্রন্থ রচনা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’
বইটির তত্ত্বাবধানের কাজে ছিলেন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান। অনুষ্ঠানে তিনি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
বইটির মুখবন্ধতে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘সরকারি ডকুমেন্ট যেভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল সেভাবেই রাখা হয়েছে। অনেক সময়ে বক্তৃতাগুলির নোট নিতে গিয়ে লেখয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভুল করেছেন, আবার বৃষ্টিতে মুছে গেছে দীর্ঘ দিনের পুরাতন হওয়ার কারণে কিছু দলিলের অংশ বিশেষ নষ্ট হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম তৎকালীন অফিসারগণ বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে লিখেছেন। এমনকি এক জায়গায় মুজিবুর রহমান খানও লেখা আছে। পাঠকগণ বুঝে নিবেন আশা করি।’
মুখবন্ধের আরেক জায়গায় লেখা হয়েছে, কিছু বানান ও ভিন্নার্থক শব্দের সংশোধনী এই বইয়ের শেষে দেওয়া হয়েছে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় ‘উধপপধ’ বানানটি বইয়ের সর্বত্র একইরূপ রাখা হয়েছে। বইয়ে কিছু কিছু ডকুমেন্টের ইমেজ সংযোজন করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য সচিব শেখ আজিজুর রহমান ও হাক্কানী পাবলিশার্সের কর্নধার গোলাম মোস্তফাও বক্তব্য দেন।
বইটির সম্পাদনা করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধাদের। উৎসর্গ পত্রে লেখা আছে-‘বঙ্গবন্ধু তার সংগ্রামী জীবনের সকল সহযোদ্ধাদের প্রতি’। ৫৮২ পৃষ্ঠা সম্বলিত প্রথম খণ্ডের মূল্য ৯০০ টাকা। প্রতিটি খণ্ডের প্রচ্ছদের ডিজাইন এক। প্রচ্ছদ করেছেন সমর মজুমদার।